মাদরাসার অনেক ছাত্র নিজেদের আখলাক-চরিত্র গঠনের প্রতি খেয়াল করে না। ছাত্রদের আখলাক-চরিত্র ও তাদের ব্যবহার মধুর হওয়া চাই। তাদের চলাফেরা, আচার-আচরণ দেখে সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হবে এবং নিজেদের ভিতর সেরকম গুণাবলি অর্জন করতে চেষ্টা করবে। মাদরাসার ছাত্রদের পোশাক-পরিচ্ছদ, তাদের চলাফেরা ও আমল-আখলাক এমন হওয়া চাই যে, তাদের দেখলে স্বর্ণযুগের সেই সাহাবিদের কথা মনে হবে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মনে হবে।
অতীতের অনেক ঘটনা এমন আছে যে, মুসলমানদের চেহারা ও ব্যবহার দেখে অনেক কাফের মুসলমান হয়ে গেছে। যেমন সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.) নবীজির চেহারা দেখে মুসলমান হয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে ১ লাখ কাফের একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেছে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন, মক্কার সুদীর্ঘ তেরো বছরে মুসলমানের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য, আর মদিনার জীবনের প্রথম ছয় বছরে কাফেরদের সঙ্গে বড় বড় ছয়টি যুদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ ও খন্দকের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধে যে পরিমাণ মুসলমান শহীদ হয়েছেন, সে পরিমাণ লোকও তখন মুসলমান হননি। তাহলে মক্কার তেরো বছর এবং মদিনার ছয় বছর মোট ১৯ বছরে মুসলমানের সংখ্যা মক্কায় ১ হাজারও বৃদ্ধি পায়নি। এ ১৯ বছর চেষ্টা-প্রচেষ্টা যুদ্ধবিগ্রহের পর মদিনায় কিছু লোক মুসলমান হয়েছেন। তবু মুহাজির ও আনসার মিলে মাত্র ১০ হাজারের মতো। কিন্তু ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি হলো আর অষ্টম হিজরিতে এক/ দেড় লাখ কাফের মুসলমান হয়ে গেল। আমাদের দেশের দলনেতারা জনস্রোত যখন ইসলামের প্রতি ধাবিত দেখেন, তখন তারা ইসলাম! ইসলাম!! বলে খাঁটি মুসলমান হয়ে যান। এমনিভাবে মক্কার কাফের দলপতিরা যখন দেখতে পেলেন যে, মানুষ স্রোতের মতো ইসলাম গ্রহণ করছে, তখন তারা বুঝতে পারলেন, তাদের নেতৃত্ব আর বজায় থাকবে না। তাই তারাও মুসলমান হয়ে যান। কিন্তু আল্লাহপাক মহান, তাই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মুসলমান হয়েছেন, তাদের সবাইকে বিনা শাস্তিতে গ্রহণ করেছেন। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ গবেষণার পর এ বিরাট পরিবর্তনের কারণ হিসেবে যোগ করেন যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ ছিল, দূরত্ব ছিল। চলাফেরা-লেনদেন ওঠাবসা সবই বন্ধ ছিল। দূর থেকে একজন অপরজনকে নিজের জানের শত্রু মনে করত। আর নেতাদের কাজ ছিল, তাদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেওয়া। তারা নিজের অনুসারীদের কাছে মুসলমানদের সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর মিথ্যা কথা বলে হিংসার বীজ বপন করত, যথা- মুসলমানরা অতি হিংস্র মানব, তাদের ভিতর মনুষ্যত্ব নেই, এরা সমাজের অতি নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত লোক, এরা সন্ত্রাসী; মুসলমান মানেই বর্বর জাতি ইত্যাদি। এসব অপপ্রচার চালিয়ে তারা সাধারণ সরলমনা মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখত। কিন্তু যখন ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়- মক্কার কাফের ও মদিনার মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর ব্যবসাবাণিজ্য লেনদেন শুরু হয়, তখন মুসলমানদের আচার-আচরণ ও সততা দেখে তারা আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল, এরা তো আমাদেরই ভাই-ভাতিজা, এদের ভিতর এত পরিবর্তন এলো কোত্থেকে। এদের মধ্যে এত বেশি দয়ামায়া, উদারতা কীভাবে সৃষ্টি হলো? সৃষ্টির প্রতি এরা এত উদারমনা কেন? এরা এত সভ্য কীভাবে হলো? এসব প্রশ্ন তাদের অবাক করে তোলে। ফলে তারা আন্তরিকভাবে ইসলাম সমর্থন করতে থাকে; কিন্তু লিডারদের চাপে তা গোপন রাখে। অবশেষে যখন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন আর তাদের মনে লিডারের ভয় থাকেনি। যার ফলে সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। মাদরাসার ছাত্রদের আমল-আখলাক দেখে প্রতিবেশী সব মানুষের আমল-আখলাক ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছু ছাত্র আছে, যারা ঠিকমতো আমল করে না। সর্বদা অজু অবস্থায় থাকে না। তাদের মাঝে এশরাক ও তাহাজ্জুদের পাবন্দি নেই, তারা চঞ্চল ও অস্থির থাকে, নবীয়ানা আখলাকের ছাপ তাদের চেহারায় নেই। আমি বসে বসে চিন্তা করি- আমার চরিত্র যেমন, ছাত্রদের চরিত্রও তেমন হওয়া উচিত। কিন্তু সেই চরিত্র তাদের মাঝে আসছে না কেন? তাহলে কি আমার মধ্যে সেই চরিত্র নেই? হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও!
ছাত্রদের আমল যদি সুন্নত তরিকা অনুযায়ী হয়, তবে এর প্রভাব এলাকার মানুষের ওপর পড়বে। মাদরাসার ছাত্র যদি দোকানে বসে পত্রিকা পড়ে, তাহলে এ ছাত্র দোকানিকে কীভাবে বলবে, হে দোকানদার ভাই! পত্রিকার এ ছবিগুলো দেখা হারাম, তাই তা দেখবেন না। ছাত্রের এমন কথা শুনলে দোকানদারের মনে এ ছাত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি সৃষ্টি হবে এবং সে মনে মনে বলবে, ছাত্রটি কতই না নেককার। এই তো আসল ছাত্র। আর এটাই হলো ইসলামি আদর্শের শিক্ষা।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ