সিয়াম সাধনার মাহে রমজান শেষে ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে হাজির হতে যাচ্ছে খুশির সওগাত নিয়ে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে ঈদ পালিত হচ্ছে মুক্ত পরিবেশে। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ এ বছর তুলনামূলকভাবে স্বস্তিদায়ক পরিবেশে পবিত্র রমজানে রোজা পালন করতে পেরেছে। চাল, সয়াবিন তেল, খেজুরসহ কিছু পণ্যের দাম বাড়লেও বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম ছিল রোজার আগের মতোই। এ বছর ঈদ উপলক্ষে প্রায় দেড় কোটি মানুষ রাজধানী ঢাকা ছাড়ছেন। নাড়ির টানে তারা ঈদ পালনে ছুটেছেন স্বজনদের কাছে। যানবাহনের ওপর বাড়তি যাত্রীর চাপ থাকলেও এ বছর ঈদযাত্রা তুলনামূলকভাবে স্বস্তিদায়ক। তবে ঈদের ছুটিতে জননিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে দেশজুড়ে। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জেও জননিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সর্বস্তরের মানুষকে। সরকারের পক্ষ থেকে ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর নিরাপত্তা রক্ষায় বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাগ্রত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা আশা করব এ ব্যাপারে পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাফল্যের পরিচয় দেবে। ঈদের ছুটিতে বেপরোয়াভাবে যানবাহন চলাচল করার কারণে প্রতিবছর দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায়। আহত হয় আরও অনেকে। সড়ক দুর্ঘটনা যাতে কোনো পরিবারে বিষাদের ছায়া বিস্তার না করে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই সতর্ক থাকার চেষ্টা করব। বাংলাদেশের মানুষ যথাযথ মর্যাদায় পবিত্র ঈদুল ফিতর পালন করতে পারলেও আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই ও বোনেরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফিলিস্তিনের গাজায় মাহে রমজানে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ইসরায়েলের ইহুদিবাদী বর্বর সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। ২০ লাখ গাজাবাসী মুসলমানের ঘরে এ বছর ঈদের দিনেও কান্নার ধ্বনি শোনা যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল হিটলারের নাজি বাহিনী। মানবসভ্যতার জন্য যা কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় সব মানুষ জার্মানির নাজি বাহিনীকে ধিক্কার জানিয়েছে। বিশ্ববাসীর সহানুভূতির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদিরা। সভ্য মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেই মহাবিপদের দিনে। মানবসভ্যতার বিকাশে যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল বিশ্ববাসীর ঐক্য। এ ঐক্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয় নিশ্চিত করে। গণহত্যা ও নির্যাতন-নিপীড়ন কত ভয়াবহ, তা ইহুদিদের চেয়ে আর কোনো জাতির বেশি জানা নয়। আশা করা হয়েছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা ইহুদিদের আরও মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করবে। তারা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বে শান্তি ও মানবিকতার প্রতিভূ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে। কিন্তু জগতবাসীর প্রত্যাশাকে অবজ্ঞা করে তারা নাৎসিবাদের আদলে ইহুদিবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। ফিলিস্তিনিদের তাদের দেশ থেকে উৎখাত করে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করেছে পশ্চিমা শক্তির মদতে। ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল যে অপভূমিকা রাখছে, তার মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে নাৎসিদের ইহুদি নিধনকেই বৈধতা দান করছে বললেও কম বলা হবে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্ব শান্তির জন্যও সাক্ষাৎ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ইহুদিবাদীরা। জাতিসংঘকে শিখন্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের অর্ধেক এলাকায় ইসরায়েল নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাদবাকি এলাকায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল জাতিসংঘ। কিন্তু পরবর্তীতে ইহুদিবাদীরা পুরো ফিলিস্তিন গ্রাস করার ধৃষ্টতা দেখালেও জাতিসংঘ নীরব। ফিলিস্তিনের গাজা ভূখন্ডে তারা নৃশংস হামলা চালিয়েছে ১৭ মাস ধরে। পরে যুদ্ধবিরতি মেনে নিলেও নানা অজুহাতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে গাজা উপত্যকায়। ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী জাতি ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। ১৭ মাস আগে ফিলিস্তিনের উগ্রবাদী সংগঠন হামাসের হামলায় ইসরায়েলের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর হামাসবিরোধী অভিযানের নামে প্রকারান্তরে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করে তেলআবিবের বর্বর শাসকরা। গত ১৭ মাসে ইহুদিবাদীদের হাতে নিহত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি। যাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু। এ পর্যন্ত আহত হয়েছে সোয়া লাখ মানুষ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর আচরণে মনে হয় না তারা তাদের ফিলিস্তিনি ভাইয়ের ওপর হামলায় আদৌ মর্মাহত। সভ্যতার সোল এজেন্ট পশ্চিমা দুনিয়ার মদতে ইসরায়েল যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা পেয়েছে। আরব দেশগুলোর নির্বিকার ভূমিকা আগের শক্তিকে সাহস জোগাচ্ছে। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। সত্তর দশকে আট হাজারের বেশি বাংলাদেশি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। শতাধিক বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে সেই যুদ্ধে। মুসলমানদের প্রথম কেবলা এবং পবিত্র মক্কা ও মদিনার মসজিদের পর তৃতীয় পবিত্র স্থান মসজিদুল আকসা এখন ইসরাইলের দখলে। এ বছরের ঈদুল ফিতরে ঈদের জামাতে শুধু দোয়া করা নয়, দুনিয়ার সব মুসলমানের শপথ নেওয়া উচিত ইহুদিবাদীদের দখল থেকে পবিত্র মসজিদুল আকসাকে মুক্ত করা। ফিলিস্তিনিরা যাতে তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায় তা নিশ্চিত করাও প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। সবাইকে ঈদ মুবারক।
♦ লেখক : প্রাবন্ধিক