জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম।
গতকাল বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন তারা। পরে ট্রাইব্যুনাল দাখিল করা পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে আদেশ দিয়েছেন। এ মামলার অন্য দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। একই সঙ্গে এ মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অন্য আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এ মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। এর আগে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গতকাল দুপুর ১২টার পর ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেন। গতকালের এ বিচারিক কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হয় টেলিভিশনে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক পেজেও সরসারি সম্প্রচার করা হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজেও লিঙ্ক শেয়ার করে এ বিচার সরাসরি সম্প্রচার হয়, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম।
১২ মে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনে জুলাই গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে এসেছে।
গতকাল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের সময় ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, ‘আজ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে এই ট্রাইব্যুনালের এই পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন আইনজীবীই নই, ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ববিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিচার শুরু করেছি জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে; যেখানে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ-ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু; যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কুপ্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৪-এর এ আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এ মামলার অভিযুক্ত আসামিদের কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকা ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো।’
আদালতকে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা “মনসুন রেভল্যুশন” বা বর্ষাবিপ্লব নামেও পরিচিত সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০২৪ সালের পয়লা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিরা সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ওইসব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালান।’
বিচারকদের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এ বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয়, বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন”, “রোম স্ট্যাটিউট অব দি আইসিসি” এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য।
এ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আমরা যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করব সেগুলো হচ্ছে-১. প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য ২. অপরাধ সংঘটনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ৩. ড্রোন এবং সিসিটিভি ফুটেজ ৪. আসামিদের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস ৫. ডিজিটাল এভিডেন্সসমূহের ফরেনসিক রিপোর্ট ৬. আসামিগণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ৭. গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও ৮. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট ৯. বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিসিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। বিচার শুরুর এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সেই সব ভিকটিমকে যারা আর কোনো দিন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসবেন না। স্মরণ করছি তাদেরও যারা এ আন্দোলনে চোখ, হাত, পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়েছেন। স্মরণ করছি সেই সব অকুতোভয় মানুষকে যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণে এ রাষ্ট্র অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।’
তিনি বলেন, ‘এ আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে, যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর এবং ন্যায়ভিত্তিক। আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।’