কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, বিশেষ একটি ইবাদত। ইসলামি শরিয়তে কোরবানির যে পদ্ধতি চালু আছে তা নবী ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ে প্রবর্তিত হয়েছে। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। এ বিষয়ে যথেষ্ট দলিলপ্রমাণ রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন, তিনি প্রতি বছর কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি)। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ধারাবাহিকতা কোরবানির গুরুত্ব বোঝায়। অপর হাদিসে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈদের দিনে রক্ত প্রবাহিত করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় বনি আদমের কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। এ কোরবানি করা পশু কিয়ামত দিবসে তার শিং, পশম, খুরগুলোসহ উপস্থিত করা হবে। এর রক্ত জমিনে প্রবাহিত হওয়ার আগেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা নিষ্ঠার সঙ্গে, আগ্রহচিত্তে কোরবানি কর।’ (তিরমিজি)। কোরবানি করা মুসলমানদের জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি সুবর্ণ সুযোগ। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা আল কাউসার, আয়াত-২)। এ আয়াতে এবং উল্লিখিত হাদিসে কোরবানি করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে। যা সাধারণত ওয়াজিব বোঝানোর জন্য ব্যবহার হয়। অপর হাদিসে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না সে যেন মুসলমানদের ঈদগাহে না যায়।’ (আহমদ)। কোরবানি যে দেবে না তার প্রতি মহানবী (সা.) এর এমন কঠোরতা কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার প্রতি নির্দেশনা বহন করে। অন্য হাদিসে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ফরমান, ‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করবে সে যেন নামাজের পর পুনরায় আরেকটি ছাগল জবাই করে।’ (সহিহ মুসলিম)। কোনো এলাকায় ঈদের নামাজের আগে কেউ কোরবানি করলে ওলামাগণের ঐকমত্যে নামাজের পর পুনরায় তাকে কোরবানি করতে হবে। ওয়াজিব আমলে ভুল হলে পুনরায় আদায় করতে হয়। ঐচ্ছিক কোনো আমল পুনরায় আদায় করার নির্দেশনা ইসলামি শরিয়তে হয় না।
যেসব অঞ্চলে চাঁদ উদয়ে ভিন্নতা হয় না ওই অঞ্চলের কোথাও জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত কোরবানি করতে হয়। এ বছর চাঁদ দেখার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে শনি, রবি ও সোমবার কোরবানি হবে। এ মাসের ৯ তারিখ (শুক্রবার) ফজর থেকে ১৩ তারিখ (মঙ্গলবার) আসর পর্যন্ত প্রতি বেলা নামাজান্তে তাকবিরে তাশরিক বলা প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নরনারীর ওপর ওয়াজিব।
প্রাপ্তবয়স্ক, সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর ওপর একটি ছাগল, ভেড়া, দুম্বা অথবা গরু, মহিষ বা উটের সপ্তমাংশ কোরবানি করা আবশ্যক। গরু, মহিষ ও উট কোরবানির ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব সাতজন মিলে কোরবানি করা যাবে। জাবের (রা.) বলেন, ‘আমরা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে হুদায়বিয়ার সময়ে উট, গরু সাতজনে মিলে কোরবানি করেছি।’ (সহিহ মুসলিম)।
যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ (শনিবার) সুবহে সাদেকের পর থেকে ১২ তারিখ (সোমবার) সুর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ (৮৭.৪৮ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা (৬১২.৩৬ গ্রাম) অথবা এ পরিমাণ রুপা সমতুল্য অর্থসম্পদের মালিক হবে তাকে সামর্থ্যবান গণ্য করা হবে। রুপার বর্তমান বাজারমূল্য রুপার মান অনুপাতে কমবেশি হয়। নেসাব হিসাবের ক্ষেত্রে খাঁটি (pure) তথা ফাইন সিলভার বিবেচনায় নিতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোচ্চ মানের স্বর্ণ-রুপা হয় ২৪ ক্যারেট (৯৯৯%)। এতে এলোয় (খাদ বা ধাতু) মেশানো হয় ১% অংশ। তবে এর লেনদেন সাধারণত কম হয়। এজন্য মূল্য সম্পর্কে অবগত হওয়াও কঠিন। ২২ ক্যারেট স্বর্ণ-রুপাতে স্বর্ণ-রুপা হয় ২২ অংশ এবং এলোয় (খাদ বা ধাতু) হয় ২ অংশ বা % ৭.৫ অংশ। এটা মোটামুটি খাঁটি গণ্য করা যায়। বর্তমানে ২২ ক্যারেট (৯২.৫% স্টার্লিং সিলভার) রুপার মূল্য ঢাকাতে প্রতি ভরি প্রায় ২ হাজার ১০০ টাকা (পরিবর্তনশীল)। এ হিসাবে সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্য আসে ১ লাখ ১০ হাজার ২৫০ টাকা। এটা হবে কোরবানি ও জাকাতের জন্য বর্তমানে মধ্যবর্তী নেসাব। ২৪ ক্যারেট হিসেবে নেসাবের পরিমাণ আরও বেশি হবে। স্বর্ণ হিসেবে নেসাব হবে আরও অনেক বেশি। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদেকের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার ২৫০ টাকা বা এর সমপরিমাণ সম্পদ যার মালিকানায় মৌলিক বা নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত হবে, তাকে কোরবানি করতে হবে। কোরবানির ক্ষেত্রে সম্পদ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি নেসাব হিসাবের ক্ষেত্রে তার ঋণ বিয়োগ করে নেসাব হিসাব করতে পারবে। মৌলিক বা নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদ বলতে ওই সব জিনিসকে বোঝানো হয় যা মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার ও প্রয়োজনে অপরিহার্য। এগুলো ছাড়া স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসম্ভব।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা