ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ। কখনো বন্যা আবার কয়েক মাস পরই খরা, কখনো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা নদীভাঙন। ইতিহাসের পাতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের বন্যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গণমানুষ অত্যধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যকর ও দক্ষ ভূমিকা বরাবরই প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে।
সম্প্রতি বিশ্ব জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের আবহাওয়ায়ও এমন চরম অনেক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা ১০ বছর আগেও তেমনভাবে চোখে পড়েনি। আবহাওয়ার চরম বৈরিতার উদাহরণ যেমন মাত্রাতিরিক্ত বন্যা, শীত কিংবা গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলা। এরই ধারাবাহিকতায় গত আগস্ট মাসে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে নেমে আসে এক অভাবনীয় বন্যার প্রকোপ, যা আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে।
গত আগস্টের বন্যা বাংলাদেশের সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় বন্যা বলে মনে করা হচ্ছে। আলোচিত এ বন্যায় কতজন মানুষের প্রাণ গেছে, তা নিখুঁতভাবে হিসাব দেওয়া কঠিন হবে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলীর মতে, প্রাণ যাওয়া পুরুষের সংখ্যা ৪৫ জন, শিশু ১৯ জন এবং নারীর সংখ্যা ৭ জন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন, শিক্ষকসমাজ, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী থেকে শুরু করে দেশের সর্বস্তরের জনগণ তাদের সর্বোচ্চ শক্তিসামর্থ্য ও সম্পদ দিয়ে বন্যা মোকাবিলায় কাজ করেছিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এ কাজটি মূলত তিনটি ধাপে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পন্ন করেছিল। প্রথম ধাপটি ছিল- প্রি-ডিজাস্টার ফেজ অর্থাৎ দুর্যোগ-পূর্ববর্তী ধাপ। এ ধাপে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি, ঝুঁঁকি মূল্যায়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি, পূর্বাভাস এবং পরিকল্পনা করা হয়। এ সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে বন্যার পূর্বাভাস সংগ্রহ করেছিল এবং তা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কাছে বন্যার পানি আসার আগেই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এ ছাড়াও তারা কুমিল্লা, ফেনী এবং নোয়াখালীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যেসব আশ্রয়কেন্দ্র আছে, সেগুলোর দেখভাল করেছিল এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল। জনগণের যেন ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যথেষ্ট সজাগ অবস্থানে থেকে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল অত্যন্ত সুচারু ও সুপরিকল্পিতভাবে।
দ্বিতীয় ধাপটি ছিল ডিউরিং ডিজাস্টার ফেজ অর্থাৎ দুর্যোগকালীন। এ ধাপে দুর্যোগ চলাকালীন জরুরি প্রতিক্রিয়া, উদ্ধারকাজ এবং ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, এসবিপি, ওএসপি, এসজিপি, পিএসসি দুর্যোগপূর্ণ এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ও বন্যার্ত মানুষকে সাহস দেওয়ার জন্য ফেনী জেলার পরশুরাম ও আশপাশের এলাকায় বহুবার সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশনা মোতাবেক বন্যাদুর্গতদের সহযোগিতা করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, যখন মানুষ বন্যার তীব্র স্রোতে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিগি¦দিক ছুটে যাচ্ছিল, ঠিক সে মুহূর্তে সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নিজেদের জীবনদানে নিবেদিত হয়ে অসহায় মানুষের তল্লাশি করেছিলেন, যেন একটি মানুষও বিপদে না পড়ে। ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটের বিশেষ বোট নিয়ে সেনাসদস্যরা ঢুকে পড়েছিলেন বন্যাকবলিত এলাকার প্রত্যন্ত স্থানে। পর্যায়ক্রমে সেসব এলাকা থেকে জরুরি ভিত্তিতে অসুস্থ, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর এভাবেই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বন্যাদুর্গত মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপটি ছিল পোস্ট-ডিজাস্টার ফেজ বা দুর্যোগ-পরবর্তী ধাপ। এই ধাপের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের জীবনমান পুনরুদ্ধার করা এবং এ দুর্যোগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মোকাবিলা করা। বন্যা-পরবর্তী সময়ে বন্যাদুর্গত পরিবারের মাঝে সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় পোশাক বিতরণ করেছিল। নারীদের জন্য বিশেষভাবে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে মহিলাদের মাঝে হাইজিন কীট বিতরণ করা হয়েছিল। এ বন্যায় কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থা ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের বাড়িঘর মেরামত কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদান, ত্রাণ বিতরণ এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, যা সেসব অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তিনটি ধাপেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল এক নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ সারথি হিসেবে, যেখানে তারা নিজেদের প্রমাণ করেছে দুর্যোগ মোকাবিলায় সফলতার মূল চাবিকাঠি হিসেবে। তাদের আত্মত্যাগী ভূমিকা প্রমাণ করে, মানবতার সেবায় সেনাবাহিনী শুধু রক্ষকই নয়, তারা দেশের সর্বস্তরের মানুষের আশাভরসা, সাহস ও বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের করণীয় অনেক। মাতৃভূমি বাংলাদেশে যেহেতু বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়, বিশেষ করে বন্যার শঙ্কা থাকে, সেজন্য বন্যা রোধে ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কীভাবে কমানো যেতে পারে, এ ব্যাপারে সরকারকে গঠনমূলক আশু পদক্ষেপ নিতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই। দেশের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে যেন কেউ অপরিকল্পিত ও বেআইনিভাবে নদী ভরাট করতে না পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং অন্যান্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে দুর্যোগ-পূর্বাভাস ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবহাওয়া পূর্বাভাস ও মনিটরিং প্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের আধুনিক স্যাটেলাইট, রাডার ও সেন্সরবেইজড সরঞ্জামাদি বেলা এবং এগুলোর সঠিক ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণদানে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগের মাধ্যমে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত আবহাওয়া পূর্বাভাসের ডেটা এবং অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ক্ষয়ক্ষতির ডেটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আগত যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন এবং ঝুঁঁকির মাত্রা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ সরকারকে এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
বন্যানিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের মধ্যে স্মার্ট ড্রেনেজ পদ্ধতি, বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্বয়ংক্রিয় পাম্প স্থাপন, ভূস্থানিক ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকায় দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছানো এবং পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, বন্যাপ্রবাহ রোধ পরিকল্পনায় সবুজায়ন বৃদ্ধির উদ্যোগ থাকতে হবে। এ ছাড়াও পোস্ট ডিজাস্টার ফেজের কর্মকাণ্ড আরও স্বয়ংক্রিয় ও গঠনমূলক করার ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর সহায়ক টুলসের ব্যবহার নিশ্চিত হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ জরুরি সতর্কীকরণ ও স্বয়ংক্রিয় পাবলিক ঘোষণা পদ্ধতি ও স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবহার, অনুসন্ধান উদ্ধারকাজে বিশেষ ড্রোনের ব্যবহার, জরুরি অবস্থায় বহনযোগ্য সৌর চার্জারের ব্যবহার ইত্যাদি। নদীর বাঁধ ও ডাইক নির্মাণ, বাঁধের মেরামত এবং নদীর তলদেশের অবকাঠামোগত সংস্কার করতে হবে যেন যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট বন্যার পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
অধিকন্তু বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী দেশের মাঝে অভিন্ন ৫৪টি নদীর (যেমন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) পানিপ্রবাহের ওপর গ্রহণযোগ্য চুক্তি সাধন হলে, উভয় দেশের পানিব্যবস্থাপনা আরও সুসংহত ও সুষ্ঠু হবে, যা দেশে বন্যার ঝুঁঁকি কমাতে সহায়ক হবে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে বন্যার ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো নিয়ে সব পরাশক্তি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা করতে হবে। এ ধরনের গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে আমাদের বন্যা মোকাবিলার জন্য সহায়ক বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতে হবে এবং সেসব আলোচনার মুখ্য বিষয় হবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস) মোকাবিলায় আমাদের কী কী করণীয়। সর্বশেষ মনে রাখতে হবে, যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি রোধে সরকার সফল হলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দেশ এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষের মূল্যবান জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা যাবে।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা