চুইঝাল বা পিপার চাবা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিশেষ জনপ্রিয় মসলা। এটি লতাজাতীয় গাছ। দেখতে অনেকটা পান গাছের মতোই। এর শিকড়, কাণ্ড ও পাতা বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালিতে ব্যবহৃত হয়। খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা এসব এলাকায় ঐতিহ্যবাহী রান্নার উপকরণ চুইঝাল। চুইঝালের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার মূলত মাংস রান্নায়। বিশেষ করে গরু, খাসি বা মুরগির মাংস রান্নায় এটি ব্যবহৃত হয়। মাংসের সঙ্গে চুইঝালমিশ্রিত করার ফলে খাবারে একটি বিশেষ ঝাল এবং সুগন্ধ যুক্ত হয়, যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু।
মসলাজাতীয় এই পণ্য এখন আর দক্ষিণের আঞ্চলিক গণ্ডিতে আটকে নেই। গত কয়েক বছরে চুইঝালের বাজার রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বাণিজ্যিকভাবেই এর চাষ শুরু করেছেন অনেক কৃষি উদ্যোক্তা। যশোর জেলার মনিরামপুরের ইফেতেখার সেলিম অগ্নি তাঁদেরই একজন। তিনি যশোরের মনিরামপুর, বান্দরবান ও কক্সবাজারে চুইঝালকে কেন্দ্র করে নিয়েছেন ভিন্ন রকম বাণিজ্যিক উদ্যোগ। ইফতেখার সেলিম অগ্নি কৃষিপ্রেমী দূরদর্শী এক উদ্যোক্তা। দেশে কাজুবাদাম চাষের সূচনায় রয়েছে তাঁর অনন্য ভূমিকা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে তাঁর বিশাল কৃষি উদ্যোগ। ৮০০ বিঘা জমিতে চাষ করছেন কাজুবাদাম, কমলা-মাল্টা, শজনে ডাঁটা। শজনে ডাঁটার সাথি ফসল হিসেবে চাষ করছেন চুইঝাল। ইফতেখার সেলিম বলেন, চুইঝালের বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে। এটি হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়ক, বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। চুইঝাল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাবলি ধারণ করে, যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। চুইঝালের শিকড় এবং কাণ্ড থেকে তৈরি করা ভেষজ ওষুধ প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে চুইঝাল উৎপাদন হয়েছে ৫৭৬ টন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৩৪৭ টন চুইঝাল। এক অর্থবছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে ২২৯ টন। গত ছয় বছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি। এই বিষয়টি মাথায় রেখে ইফতেখার সেলিম চুইঝাল নিয়ে তাঁর বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছেন। তিনি চুইঝালের চাষ করতে গিয়ে ভালো চারার চাহিদা থেকে শুরু করেন চারা উৎপাদন। যশোরের মনিরামপুরে তিনি চুইঝালের চারা উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, সাধারণ নার্সারিগুলোতে মানসম্পন্ন চারা পাওয়াটা অনেকটা লটারির মতো। ফলে ভালো চারার নিশ্চয়তা পেতেই তাঁর এই উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু চারা উৎপাদনই নয়। তাঁর রয়েছে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির কারখানাও। মূলত আধুনিক কৃষিচর্চার প্রতি বিশেষ ঝোঁক তাঁর।

দক্ষিণাঞ্চলে অনেক কৃষকই চুইঝাল চাষে যুক্ত আছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বেলে-দোআঁশ মাটিতে চুইঝালের চারা লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। লতানো গাছ বলে, বড় গাছকে আশ্রয় করে দ্রুত গাছ বিস্তার করে। একটি গাছ থেকে কাটিং পদ্ধতিতে নতুন করে চারা উৎপাদন করা যায়। এতে করে বারবার চারা কেনার প্রয়োজনও হয় না। সার হিসেবে জৈবসার দিলেই জয়। নেই বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। ফলে চুইঝালের চাষে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হয় না। পরিত্যক্ত জায়গায় এটির চাষ সম্ভব। আলতাফ নামে এক কৃষক জানান, ১০টি গাছ দিয়ে চুইঝাল চাষ শুরু করেন, সেখান থেকে দেড় লাখ টাকার চুইঝাল বিক্রি করেছেন। বাজারে চুইঝালের দর হিসেবে এটি একটি উচ্চমূল্যের ফসল। ইফতেখার সেলিম বলেন, খুলনা অঞ্চলের পাইকারি বাজারে এক কেজি ভালো মানের চুইঝালের দাম ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর কম দামের যে চুইঝাল, তার কেজিও ১ হাজার টাকার কম নয়। সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে প্রতি কেজির গড় দাম ১ হাজার ২০০ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশে চুইঝালের বাজারের আকার প্রায় ৭০ কোটি টাকার। আর এই আকার প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে।
আগেই বলেছি চুইঝাল নিয়ে ইফতেখার সেলিমের পরিকল্পনা বেশ সুদূরপ্রসারী। চুইঝালকে দেশের সব অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত করতে এবং তার স্বাদ পৌঁছে দিতে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে তিনি গড়ে তুলেছেন চুইঝাল রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে কীভাবে চুইঝাল রান্না হয় দেখার জন্য উপস্থিত হয়েছিলাম তাঁদের রসুইঘরে। সেখানে চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংস রান্না করছিলেন বাবুর্চি শেখ হাবীব হোসেন নয়ন। কথা বলি তাঁর সঙ্গে। বাড়ি সাতক্ষীরায়। বাইশ বছরের বেশি সময় ধরে চুইঝাল দিয়ে মাংস রান্না করছেন তিনি। রান্না করতে করতে বলেন, ষাটের দশকে আব্বাস হোসেন নামে এক ব্যক্তি চুকনগর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলেন ভাতের হোটেল। সেখানে তিনিই প্রথম চুইঝাল ও মাংসের চমৎকার মেলবন্ধনের রান্না প্রথম শুরু করেন তিনি। চুইঝালের তিনটি অংশই মসলা হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী। গাছের মাথার অংশটি সবচেয়ে মূল্যবান। এর পরের অবস্থান কাণ্ডের। তারপর ডালের অংশ। চুইঝাল ছোট টুকরা করে কেটে গরু, খাসি ও হাঁসের মাংস রান্না করা খুলনা অঞ্চলের ঐতিহ্য।
চুইঝালের স্বাদ নেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন। রেস্টুরেন্টে বসে যাই সদ্য রান্না করা চুইঝাল-মাংসের স্বাদ নিতে। গরুর মাংস ছাড়াও গয়াল, খাসি, হাঁস, মুরগি এমনকি গরুর বটেও দেওয়া হয়েছে চুইঝাল। পাশাপাশি আছে আস্ত রসুন। মুখে দিতেই অন্যরকম অনুভূতি। চুইঝালের ঝাঁজ আর রসুনের নরম হয়ে মুখের ভেতর গলে যাওয়ার অনুভূতি সত্যি অসাধারণ। ভোজনরসিকরা এর স্বাদের বিবরণ হয়তো আরও ভালো করে দিতে পারতেন। যাই হোক, কৃষিপণ্য হিসেবে চুইঝালের ব্যবহার বাড়ছে, কৃষক চুইঝাল চাষ করে লাভবান হচ্ছে সেটাই আমার কাছে বড় বিষয়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগও চুইঝালের চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছে। তবে এর স্বাস্থ্যকর ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দিকটাও যথাযথ বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে।
শহরাঞ্চলে ছাদকৃষি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নগরে যাঁদের নিজস্ব ভবনের ছাদ আছে তাঁদের অনেকেই বাসার ছাদটিকে গড়ে তুলছেন শস্য আয়োজনে। বস্তায় বা ড্রামে করে ছাদকৃষিতেও চুইঝালের চাষ হতে পারে। হাতিরঝিল এলাকায় এক উদ্যোক্তার ছাদকৃষিতে চুইঝালের চাষ দেখেছিলাম।
দেশের অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্য যেমন সারা দেশে ছড়াচ্ছে, এসবের সুনাম ছড়াচ্ছে দেশের বাইরেও। গুণগতমান ঠিক রেখে এসব কৃষিপণ্য উৎপাদন করা গেলে দেশে যেমন ভালো বাণিজ্যের সম্ভাবনা আছে, সম্ভাবনা আছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও।
কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে এর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে দেশের কৃষি উন্নত হবে, উন্নয়ন হবে কৃষকের। এর জন্য সুপরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, কৃষককে দিতে হবে চাষ কৌশল ও উপকরণের নিশ্চয়তা।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব