নিলুর এখন শুধু দুপুরবেলা ভালো লাগে। দুপুরে কী সুন্দর রোদ থাকে, একদম শীত লাগে না। তখন পুকুরে দুইটা ডুব দিলেও ঠান্ডা লাগে না। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে গায়ে সরিষার তেল মাখলে গা-টা যা গরম হয় না, ইস! কী ভালো লাগে তার। আবার তেলের কারণে জীর্ণ হাত-পায়ে রোদ পড়ে কেমন চিকচিক করে ওঠে। চুলগুলোতে যে শেষ কবে শ্যাম্পুর ছোঁয়া লেগেছিল জানা নাই নিলুর। একবার মাস্টার বাড়িতে কাজ করে দিয়েছিল। সেদিন ওই বাড়িতেই গোসল করতে হয় তার। তখন বড় একটা শ্যাম্পুর কৌটা থেকে মাস্টারনি ওকে শ্যাম্পু দিয়ে বলেছিল, চুলের কী অবস্থা করেছিস, লাল লাল হয়ে গেছে, একটু শ্যাম্পু দে। যাওয়ার সময় তেল নিয়ে যাস মনে করে। নিলুর দাঁত ছাড়া হাসি হেসে বলেছিল, আম্মা কইছে কয়দিন পরে ফালায়া দিব চুল, হুদাই যত্ন কইরা কী হইব।
নিলুর সামনের ওপরের পাটির দুইটা দাঁত পড়েছে, মানে এখন তার বয়স ৭-এর আশেপাশে। নিলুর মা নিলুকে ঢাকা এক বাসায় কাজের জন্য পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। নিলু রাজি হয়নি, গ্রামে তার সবাই আপন। মাস্টারনি কত আদর করে! আরও আছে সাদা দাড়িওয়ালা কুদ্দুস দাদা, পূবপাড়ার মেজো কাকি। সবাইকে ছেড়ে সে ঢাকা এক বাসায় বন্দি থাকতে পারবে না। এখন নিলু প্রায় সব বাড়িতেই কাজ করে, নির্দিষ্ট এক বাড়িতে তার মন বসে না। কারও ছাগল নিয়ে চরে যায়, কিংবা উঠান ঝাড়ু দিয়ে দেয়, নয় তো কারও তরকারি কাটে। কিন্তু তার শর্ত হলো বিনিময়ে তাকে মজা দিতে হবে, ভাতও না টাকাও না, তার শুধু মজা চাই।
একদিন পাড়ার মসজিদে সভার ঘোষণা হলো, আর সভা মানেই মেলা হবে। নিলুর চোখে ঘুম নেই, খুশিতে লাল-নীল আলো জ্বলছে চোখে, কারণ ওর বাবা বলেছে বিকালে মেলায় নিয়ে যাবে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো, ওর বাবা যে রিকশা নিয়ে বের হলো এখনো বাড়ি ফেরেনি। এদিকে সবাই বাঁশিতে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে বাড়ি ফিরছে। চোখে জল টলমল করছে। মার কাছে বায়না ধরল ওকে কিছু টাকা দেওয়ার জন্য, তাহলে সে একাই মেলায় যেতে পারবে। মা বারবার মানা করছে, কিন্তু কে শুনে কার কথা! শেষে কান্না করতে করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে, নিলুর বাবাও বাড়ি ফিরেছে। মেয়েকে ঘরে না পেয়ে পুকুরঘাটে গেল। নিলু পুকুরপাড়ে কলাপাতা বিছিয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিলুর বাবা মেলা থেকে আনা এক ডজন লাল কাচের চুড়ি মেয়েকে পরিয়ে দিল। নিলুর ঘুমও ভেঙে গেল। এবার নিলু চুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘লাল চুড়ি আমার আছে। আমি তো লাল গাড়ি কিনতে চাইছিলাম। রবিন কিনেছে, ওইটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি। তুমি লাল চুড়ি ফেরত দিয়া লাল গাড়ি আইনা দেও।’
নিলুর বাবা জানে এই গাড়ির দাম হবে অনেক। তিন দিনের সংসার খরচ চলে যাবে এক গাড়ির টাকা দিয়ে। তা-ও মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘কালকে বড় বাজার থেকে কিনে আনব। এখন তুই চুড়িগুলোই পর। এগুলো ফেরত দেওয়া লাগবে না।’
নিলুর চোখে খুশির ঝলক।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিলু হাজির রবিনদের বাড়ি। রবিন তো রিমোটও ধরতে দেয় না নিলকে। নিলু শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে কীভাবে চালাতে হয়। বাবা গাড়ি নিয়ে এলে তো চালাতে হবে।
বিকালে বাবা ফিরল, কিন্তু সঙ্গে গাড়ি ফিরল না। বাবা বলেছে বড় বাজারে গাড়ি নেই, শহর থেকে আনতে হবে। সামনের সপ্তাহে শহরে যাবে গাড়ি আনতে। নিলুও মেনে নিল। এভাবে মাস কেটে গেল, দেখতে দেখতে ছয় মাস পার হলো। গাড়ি আর বাড়ি এলো না।
একসময় নিলু বুঝতে পারল, গাড়ি ঠিকই বড় বাজারে আছে, শুধু বাবার পকেটে গাড়ি কেনার টাকা নেই।
এবার নিলু সিদ্ধান্ত নিল, বাড়ি বাড়ি কাজ করে আর মজা খাবে না, টাকা নেবে। তারপর টাকা জমিয়ে গাড়ি কিনবে।
নিলু একটা বাঁশের মধ্যে ছিদ্র করেছে। এটার মধ্যেই সে টাকা জমাবে। এক কাজ দুই টাকা। যত বড় কাজ হোক বা ছোট কাজ, দুই টাকা তাকে দিতে হবে। মজার কথা হচ্ছে, মাস্টারনি কাকির কাজ করে দিলে নিলু পায় পাঁচ টাকা।
একদিন মাস্টারনি কাকি নিলুকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই তো আগে মজা নিতি, এখন কেন টাকা চাস?’
নিলু বলেছিল, ‘লাল গাড়ি কিনব, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি! সাঁই সাঁই কইরা চলে।’
এর পর থেকেই তিনি নিলুকে দুই টাকার বদলে পাঁচ টাকা দেন।
দেখতে দেখতে অনেক দিন পার হয়ে গেল। নিলুকে ওর মা প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে দিল। এখন সে স্কুলে যাওয়ার জন্য কাজ করতে পারে না। কিন্তু ওর মা বলেছে, স্কুলে গেলে স্কুল থেকে টাকা দেবে। তখন ওর জমানো টাকা আর স্কুলের টাকা মিলিয়ে গাড়ি কিনতে পারবে। এই কথা শুনে অবশেষে নিলু স্কুলে যেতে রাজি হলো।
কত টাকা জমিয়েছে, তা জানার ইচ্ছা হয়, তবু বাঁশ থেকে টাকা বের করে না। যদি বাবা নিয়ে যায়, এই ভয়ে। নিলুর মা বলেছে, এবার অনেক টাকা হয়েছে। একদিন বাবার সঙ্গে বড় বাজারে গিয়ে গাড়ি কিনে আনুক।
শুক্রবারে হাটবার, তাই শুক্রবার বিকালেই যাবে ঠিক হলো। নিলু শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে ওঠে, মায়ের সঙ্গে সব কাজ সেরে গোসল করে মোটামুটি রেডি হয়ে গেল। দুপুরে বাবা খেতে এলে মুখে পাউডার আর কানের দুল পরবে। লাল চুড়িও নামিয়ে রেখেছে পরার জন্য।
দুপুর ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। হঠাৎ নিলু তার জগলু কাকার ডাক শুনতে পেল, ‘নিলু, নিলুরে! তোর মা কই, সর্বনাশ হয়ে গেছে!’
নিলুর মা দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। কাকা কী বলল, নিলু শুনতে পেল না, শুধু মার কান্নার আওয়াজ পাচ্ছে। নিলু বের হয়ে বারান্দায় আসতেই মা বলল, ‘নিলুরে, তোর বাপের ওপর দিয়া ট্রাক চইলা গেছে!’
মা এটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাকা বলছে, ‘কান্নার সময় নাই, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাওয়া লাগবে।’
মা বাইরে থেকেই দৌড় দিল। নিলু কী করবে বুঝতে পারছে না। মার পিছু পিছু যাবে নাকি বাড়িতে থাকবে! বাবা কি আর বাড়ি ফিরবে না? লাল গাড়ি কিনে দেবে না? তখনই নিলুর খেয়াল হলো, বাবার তো বাঁচতে হবে আগে।
সে ওদের চৌকির নিচ থেকে জমানো টাকার বাঁশটা নিয়ে মার পিছু পিছু দৌড় দেয়।
বছর কেটে গেছে। নিলুর বাবা হাঁটতে পারে না। মাকে ধরে ধরে সকালে বাইরে এসে বসে, বিকালে আবার মা ঘরে নিয়ে যায়। এখন মা আর নিলুর স্বল্প আয়ে সংসার চলে। কত টাকা হাতে আসে যায়, নিলু এখন বুঝে লাল গাড়ির থেকেও দুমুঠো ভাত অনেক দামি, অনেক প্রয়োজন।
সেদিন নিলুর জমানো টাকা বের করা হলে গুনে দেখে সেখানে সাত হাজার চারশত বত্রিশ টাকা। আর এই টাকা দিয়েই বাবার চিকিৎসা করা হয়েছিল।
নিলু সেদিন গাড়ি পাওয়ার থেকেও বেশি খুশি হয়েছিল। তার জমানো টাকা যে বিফলে যায়নি।