শেরপুরের গজরিপায় অবস্থিত ঐতিহাসিক জলাশয় কালিদহ সাগর এক সময় ছিল ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা ও পৌরাণিক কাহিনীর অনন্য মিলনস্থল। মুসলিম আধ্যাত্মিক সাধক জরিপ শাহের স্মৃতি এবং ফিরোজ শাহের সেনাপতি হুমায়ুন খাঁর শাসনকালের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এটি।
অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ স্থানটি বিখ্যাত মনসামঙ্গল কাব্যের কিংবদন্তি চরিত্র চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরী বা ডিঙ্গি, শিবের পালিতা কন্যা সর্পদেবী মনসা দেবীর অভিশাপে ডুবে যাওয়ার কাহিনীর জন্য। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, এখানেই চাঁদ সওদাগরের সাত পুত্র মারা যান। শত শত বছর ধরে এই সাগরকে ঘিরে অসংখ্য লোককথা ও পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে।
এটি মুসলিম ও হিন্দু—দুই সম্প্রদায়ের কাছেই একটি পবিত্র স্থান। এখানে প্রতি বছর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বারণী স্নান, পাঠাবলি ও মেলার আয়োজন করে থাকেন। অপরদিকে, সাগরের পাশে রয়েছে মুসলিম বুজুর্গ জরিপ শাহের মাজার ও প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ। কিন্তু বর্তমানে দূষণ ও দখলের কারণে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি হারিয়ে যাওয়ার পথে।
ইতিহাসের পাতা থেকে
ইতিহাস অনুযায়ী, ১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তাঁর সেনাপতি মজলিস খাঁ হুমায়ুনকে সেনাবাহিনীসহ এ অঞ্চলে পাঠান। মজলিস খাঁ শেরপুর আক্রমণ করেন, তখন গজরিপায় রাজত্ব করতেন কোচ রাজা দলিপ সামন্ত। যুদ্ধে দলিপ সামন্ত পরাজিত ও নিহত হন। এর পর থেকেই ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়।
শাসনের অংশ হিসেবে হুমায়ুন খাঁ মজলিস গজরিপায় প্রায় ১১০০ একর জমির ওপর একটি দূর্গ নির্মাণ করেন, যা ছিল তৎকালীন রাজধানী ও সেনানিবাস। এই দূর্গটি ছিল সাতটি প্রাচীর দ্বারা বৃত্তাকারে ঘেরা এবং ছয়টি পরিখা দ্বারা পৃথক করা। সেই ছয় পরিখার একটি হলো কালিদহ সাগর। সময়ের বিবর্তনে অন্যান্য নিদর্শন বিলুপ্ত হলেও কালিদহ সাগর কোনোভাবে টিকে আছে, যদিও এখন তা দখল ও দূষণের কবলে।
লোককথা ও ধর্মীয় বিশ্বাস
জনশ্রুতি আছে, মুসলিম সাধক জরিপ শাহ মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে জিনের সাহায্যে এক রাতে এই বিশাল জলরাশি সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে সেটিই ‘কালিদহ সাগর’ নামে পরিচিত হয়।
সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে একটি লম্বা উঁচু স্থান রয়েছে—দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ ফুট, প্রস্থ ১৮ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত। স্থানীয়দের মতে, এখানেই চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গি ডুবে গিয়েছিল। এ স্থানটি আজও সবার কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও সংবেদনশীল। বিশ্বাস করা হয়, অপবিত্র শরীরে কেউ ওই স্থানে গেলে অমঙ্গল বা মৃত্যুও ঘটতে পারে।
বৃদ্ধরা বলেন, একসময় বিয়ে বা পূণ্য কাজের আয়োজন হলে সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে কেউ যদি পিতলের হাঁড়ি, পাতিল বা প্লেট চাইত—তবে সাগর থেকেই সেইসব জিনিস ভেসে আসত। আবার গুনে গুনে ফেরত দিতে হতো। এইসব গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লোকমুখে প্রচলিত।
বর্তমান অবস্থা
স্থানীয়দের দাবি, সরকার যদি দখল ও দূষণ বন্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়, তবে এটি ধর্মীয় তীর্থস্থান ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বর্তমানে কালিদহ সাগর পরিণত হয়েছে পচা, দুর্গন্ধযুক্ত, কচুরিপানা ও আগাছায় ভরা এক জলাশয়ে। সাগরের অধিকাংশ জমি এখন ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়ে গেছে। মাত্র ছয় শতক জমি এখনো দেবতার নামে রয়েছে।
স্থানীয় আলেম মাওলানা মো. হাবিবুর রহমান এবং শেরপুর জেলা পুরোহিত কল্যাণ সমিতির সভাপতি বিজয় কৃঞ্চ চক্রবর্তী বলেন, কালিদহ সাগর মুসলমান ও হিন্দু—দুই ধর্মের মানুষের জন্যই পবিত্র ও আবেগের স্থান। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা গেলে এটি হবে দুই ধর্মের মিলনস্থল।
শেরপুর জেলা প্রশাসক মাহমুদুর রহমান বলেন, বিষয়টির আদিপ্রান্ত খুঁজে দেখে এর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
বিডি-প্রতিদিন/মাইনুল