গল্প
রূপা হয়তো এখন আধুনিক হেয়ার স্টাইলসমেত জেলমাখা চুলের ছিপছিপে সেই যুবককে নিয়ে পুরো শহর চষে বেড়ায়। কিংবা কফি শপের নির্জন ক্যাবিনে বসে কোমল পানীয়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে মন ও দেহের উষ্ণতা জুড়োয় সন্তর্পণে। অথবা ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় ফ্যান্টাসির দুনিয়ায়। কুয়াশার রূপ ধরে হিম-শীতল শিশিরের জল এসে তাকে ধুয়ে দিয়ে যায়। কাঠগোলাপের ডাল পথের ওপর ফুলকাঁটা ছায়া দোলায়। বেলে হাঁসের পালকের মতো হালকা শরীর নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে আর সব পরিচয় বিলুপ্ত করে নিজ অহমে বিন্দুর মতো মিশে গিয়ে মন ডুবিয়ে রাখে আশ্চর্য এক স্থৈর্য্যরে অতল দিঘির মধ্যে। সেখানে মন্থর গতিতে চলে তার যৌবনতরী আর জীবনটাকে ঘড়ায় তোলা জল বানিয়ে পছন্দমতো গেলাসে গেলাসে ঢেলে ইচ্ছামতো পান করে। কিছু মুহূর্তকে দেয় মুঠোফোনের স্ক্রিনে ইউটিউব ও টিকটকের মৌজমাস্তি। কিছু মুহূর্তকে দেয় রক গানের উপহার। কিছু মুহূর্তকে দেয় কারও নীল চোখে চেয়ে থাকার সুখ। আর কিছু মুহূর্তকে দেয় রেস্টুরেন্টের নির্জন ক্যাবিনে যুবকের মুখোমুখি বসে থাকার আনন্দ। এভাবে বোহেমিয়ান, স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে জীবন এগোয় আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেও বেশ বদলে যায়।
আমার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয়েছিল তখন রূপা ছিল রঙিন ফিতে দিয়ে মাথার চুল দুই ভাগ করে বেঁধে পাঠশালায় যাওয়া এক কিশোরী। লাউ কিংবা পুঁইয়ের মাচায় উড়ে বেড়ানো ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল। অবশ্য এখন সে পরিপূর্ণ তরুণী। কৈশোরের চঞ্চল স্বভাবটা পেরিয়ে এসেছে আপন নিয়মে। ঝরনা থেকে নদী হয়েছে গতি হারিয়ে, আর কিশোরী থেকে হয়েছে তরুণী। এখন কলেজ ও ক্যাম্পাস ছাড়া বাকি সময়টা নিজের শোবার ঘর আর পড়ার ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বারান্দা কিংবা ছাদে যায় না। পাশের ফ্ল্যাটের শারমিনের পুতুলের সঙ্গে সেই যে তার পুতুলটার বিয়ে দিয়েছে, তাকে আর নাইওর আনা হয়নি। ননি, পনি ও টুনি নামের পুতুলগুলো শোকেসে সাজিয়ে রেখেছে সযতনে। ড্রয়িংরুমে রাখা টেলিভিশনটাতে ‘টম এন্ড জেরি’, ‘আলাদিন’, ‘গোপাল ভাঁড়’ দেখে না আর নাওয়া-খাওয়া ভোলে। শাহরুখ খান কিংবা টম ক্রুজকেও এড়িয়ে যায় রিমোট কন্ট্রোল বাটন টিপে। নানারকম গেম খেলতে বাবা অথবা বড় ভাইয়ের মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সোফা কিংবা বিছানার ওপর হাঁটু মুড়ে বসে না যখন-তখন। ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনটাতে এসএমএস, ইন্টারনেট, ফেসবুক, চ্যাট, ম্যাসেঞ্জার, ইমু, ভাইভার, হোয়াটসআপ আর স্কাইপির মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে কন্টাক্ট করে যায় নিভৃতে।
রূপা রূপ-লাবণ্যে কৈশোর পেরোতেই অপরূপ হয়ে উঠেছিল। তার রূপ-সৌন্দর্য আমাকে এতটাই আকর্ষণ করত যে, টিউশনের জন্য রূপার বাসায় যাওয়ার সময় আমি তার মুখটা মনে করে লোকাল বাসের ঝক্কি ভুলে যেতাম। ট্রাফিক জ্যামে থেমে থেমে কখন যে তার বাসায় পৌঁছে যেতাম ভাবনাঘোরে সেটা টেরও পেতাম না। আড়ষ্ট আঙুলে কলিংবেলটাতে চাপ দিতেই যেন স্বর্গের দরজা খুলে মর্ত্যরে অপ্সরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাত। ঘরে প্রবেশ করে মুখোমুখি বসে তার সান্নিধ্য পেয়ে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বন্ধু আমিনুলকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলিনি। প্রাচীরঘেরা বিশাল সেই বাড়িতে আমি কখনো রূপার নাগাল পেতাম না। আমিনুলই সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ক্যাম্পাসে বসে একদিন আমিনুলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল টিউশন নিয়ে। আমাদের ক্লাসের অনেকেই টিউশন করে। কেবল অভাবের জন্য নয়, শখে। বাড়ির ওপর যাতে চাপ কম থাকে। টিউশন করতে আমার আগ্রহ আছে কিনা আমিনুল জানতে চেয়েছিল। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়েছিলাম। সেদিন বিকালেই আমিনুলের সঙ্গে টিউশন পাওয়ার অভিপ্রায়ে রূপাদের বাড়িতে এসেছিলাম। রূপার বাবা-মায়ের কাছে একটুখানি ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর যখন রূপাকে প্রথমবার দেখতে পেলাম তখনই একরাশ আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল মুগ্ধতার। প্রথম দিন পড়াতে গিয়ে তার পাশে বসার পর আমার মনের মাঝে যে মুগ্ধতার সুরধ্বনি তৈরি হয়েছিল তা অটুট ছিল বহুক্ষণ, এমনকি বহুদিনও।
রূপার পড়ার ঘরটা ছিল বেশ গোছানো ও খোলামেলা। মেরুন রঙের প্রশস্ত জানালার পর্দা ভেদ করে উত্তরের ঝিরঝিরে হাওয়া আসত। সেই হাওয়ার সঙ্গে মিশে আমার নাকে এসে লাগত রূপার শরীরের অনাঘ্রাত ঘ্রাণ। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে আমি তার শরীরের ঘ্রাণ নিতাম। ক্যালকুলাস বই, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর আর খাতা মেলে রূপা নির্লিপ্ত বসে থাকত। ক্যালকুলাসের দুর্বল বিষয়গুলো আমি বুঝিয়ে দিতাম। ভালো ছাত্রীর মতো তার দৃষ্টি বইয়ের পাতায় আর আমার দৃষ্টি তার মুখের ওপর নিবদ্ধ থাকত। মাঝেমধ্যে শাড়ি পরে রূপা পড়তে আসত। কুঁচি দিয়ে পরা গাঢ় নীলরঙের শাড়িতে রূপাকে তখন নীলপরীদের মতো মনে হতো। তার মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ক্যালকুলাসের ইন্টিগ্রেশন করাতে করাতে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘রূপা নামের মানে জানো?’
‘না।’ ছোট করে জবাব দিয়েছিল রূপা। তবে মুখে নয়, মাথা নেড়ে।
‘নিজের নামের মানে জানো না!’ এ কথাটা একটু বিস্মিত কণ্ঠে বলেছিলাম আর মনে মনে বলেছিলাম ‘তুমি তো রূপা নও, হীরে।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হুমায়ূন আহমেদের ‘রূপা’ বইটা পড়েছ?’
‘না, পড়িনি। তবে বইটার কথা শুনেছি। আমাকে বইটা এনে দেবেন, প্লিজ?’ রূপা ছোট বাচ্চার মতো আবদার করেছিল।
‘আচ্ছা।’ বলেই আমি একবাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
পরদিনই বইটা কিনতে নীলক্ষেতে চলে গিয়েছিলাম। আমি থাকতাম আজিমপুর। রূপার পরীক্ষার সেন্টার ছিল ইডেন কলেজে। সেদিনই ছিল রূপার শেষ পরীক্ষা। এরপর আর রূপাকে পড়াতে যেতে হবে না। হাতে আছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। নীলক্ষেতের সব দোকানে তন্ন তন্ন করে বইটি খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। শুধু ‘রূপা’ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের অন্য প্রায় সব বই পাওয়া গেল। যে দোকানে গিয়ে চাইলাম সে-ই বলে দিল- ‘ছিল, শেষ হয়া গেছে। হুমায়ূন আহমেদের অন্য বই আছে, এগুলা নেন।’
‘না রে ভাই, আমার রূপা চেয়েছে; তাকে হুমায়ূন আহমেদের রূপাকেই এনে দিতে হবে।’
দোকানির দিকে তাকিয়ে আমি অনুচ্চস্বরে কথাগুলো বলে অন্য দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই দোকানেও নেই। কী করা যায়? আমাকে বিমর্ষ দেখে দোকানি সান্ত্বনা দিল, ‘দেখুন কোথাও পেতেও পারেন।’
‘সব দোকানেই তো খুঁজলাম।’
‘বাংলাবাজারে চলে যান। ওখানে পাবেন।’
‘রূপা’ বের করেছে অন্যপ্রকাশ। বাংলাবাজারে তাদের বিক্রয় কেন্দ্র আছে। ওখানে গেলে যে পাব তা নিশ্চিত। কিন্তু আমার যে ওখানে যাওয়ার সময় নেই। আজ রূপার শেষ পরীক্ষা। কাল থেকে আর তার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। এর মধ্যেই ঘড়িতে ১২টা বেজে গেছে। এক ঘণ্টা পরই রূপার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। সে বাসায় পৌঁছার আগে আমি তার হাতে বইটা দিতে চাই। হল থেকে বের হয়ে তার জন্য বইটা হাতে নিয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কীরকম সারপ্রাইজড হয়, কতটা খুশি হয়, আমি সেটা দেখতে চাই। আরও দুয়েকটা দোকানে খুঁজলাম। তবু পেলাম না। এখানে পাব না বোধহয়। নীলক্ষেত থেকে বাংলাবাজার মোটামুটি দূরের পথ। না পেলে ওখানেই যাব। রূপার জন্য শুধু বাংলাবাজার কেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো হন্যে হয়ে বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে ১০৮ নীলপদ্মও আনতে পারি।
‘তোমার জন্য অসীম শূন্যে উড়তে পারি, হতে পারি শঙ্খচিল
মেঘের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে আকাশ থেকে আনতে পারি নীল।’
কবিতার এই লাইনগুলো কোন কবির লেখা যেন? থাকগে, কবির নাম খুঁজে বের করা এখন আমার কাজ না। এখন আমার কাজ হলো, রূপাকে খুঁজে বের করা। ফুটপাত, ঝুপড়ি, গলিঘুপচি সবখানে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। একজন কলেজ স্টুডেন্ট হয়তো এতক্ষণ আমাকে ফলো করছিল। সে আগ বাড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল, ‘ভাইয়া! আপনি অনেকক্ষণ ধরে কী খুঁজছেন?’
আমি যা খুঁজছি তাকে বলে দিলাম অসংকোচে। সেও সাহস করে আমাকে বলল, ‘একটা দোকান আছে, সেখানে পেতেও পারেন।’
আমি বেশ উল্লসিত হয়ে বললাম, ‘সেই দোকানটা কোন্ দিকে?’
‘এ রাস্তা ধরে সোজা যাবেন। তারপর বামদিকে ঘুরবেন, খাবারের দোকান দেখবেন একটা। আরেকটু এগিয়ে গেলে একটা টং দোকানে রূপা বইটি পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলেই আমি ছেলেটার দেখানো পথে এগিয়ে গেলাম। তার কথামতো গেলাম সেই দোকানে। সমুদ্র মন্থনের পর মণি পাওয়ার মতো বইটাও পেয়ে গেলাম। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বইটা শূন্যে ছুড়ে আবার লুফে নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচে ক্যাচ ধরার মতো উল্লাসে চিৎকার দিলাম। বইটা নিয়ে আমাকে এতটা আনন্দিত হওয়ার মর্মার্থ পথের লোকজনেরা বুঝতে পারল না। সবাই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল। কেউ কেউ তো অনুচ্চ স্বরে বলেও ফেলল, ‘পাগল নাকি!’
কে আমাকে কী বলল সেদিকে আমার মোটেও খেয়াল নেই। আমার খেয়ালে এখন দুই রূপা। লোকজনের কুটিল দৃষ্টি এড়িয়ে, রাজপথ মাড়িয়ে আমি ইডেন কলেজের গেটে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরই হল থেকে বেরিয়ে এলো রূপা। আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু রূপা আমার দিকে না এসে ডান দিকের পথ ধরে আধুনিক হেয়ার স্টাইলে জেলমাখা চুলের ছিপছিপে এক যুবকের কাছে এগিয়ে গেল। সেই যুবকের হাতেও আছে রূপা বইয়ের একটি কপি। বিস্মিত হলাম। রূপা যুবকটির হাত ধরে উত্তরদিকের পথ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে লাগল। এদিকে আরেক রূপা আমার হাতের মুঠোয় বন্দি হয়ে রইল।