দরজায় কড়া নাড়ছে বৈশাখ। ঋতুচক্রের পালাবদলে বসন্ত এখন শেষের পথে। পুরাতন বছরের বিদায়ের সুর বেজে উঠেছে প্রকৃতিতে। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা’ রবীন্দ্রনাথের গানে সুর মিলিয়ে পুরাতন বছরের জরাজীর্ণতা, গ্লানি ও বিষাদ ভুলে সফলতার স্বপ্নে বঙ্গাব্দ ১৪৩২-কে বরণ করবে গোটা জাতি। পান্তা, ইলিশ, মুড়িমুড়কি দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি আবহমান বাংলা সংস্কৃতি জারি-সারি, ভাটিয়ালি, পুথি-পালাসহ বর্ণাঢ্য আয়োজনে বৈশাখ উদ্যাপনে মেতে উঠবে রাজধানীসহ সার দেশ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই বৈশাখী উন্মাদনা বেশি লক্ষ করা যায়।
বৈশাখ উদ্যাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশেষ এই শোভাযাত্রা নিয়ে বরাবরের মতো এবারও ব্যস্ত সময় পার করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের শোভাযাত্রায় এবার চোখ রাখছেন সংস্কৃতি অনুরাগীরা। বাঙালির সর্বজনীন এই উৎসব ঘিরে বর্ণিল হয়ে উঠেছে চারুকলা প্রাঙ্গণ। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিকাজ।
প্রাথমিকভাবে এ বছরের শোভাযাত্রার ভাবনায় উঠে এসেছে চব্বিশের জুলাই গণ অভ্যুত্থান। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।
শোভাযাত্রার ব্যয় নির্বাহের জন্য জলরঙে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আঁকা নানান চিত্রকর্ম, সরাচিত্র, মুখোশ, পুতুলসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি ও বিক্রিতে চারুকলার শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অন্যতম জাতীয় অনুষঙ্গে পরিণত হওয়া ইউনেস্কোর স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ সফল করতে চলছে বহুমুখী কর্মযজ্ঞ।
চারুকলার বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন ধারার চারু ও কারুশিল্পীরা। কেউ বাঁশ-কাঠ কাটাকুটি করছেন, কেউ কাগজ কাটছেন; কেউ কেউ আবার সেই কাটা কাগজ বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মের গায়ে লাগিয়ে শিল্পকর্মের আসল অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত। মাথায় খাড়া দুটি শিংওয়ালা দৈত্যাকৃতির একটি প্রতিকৃতি তৈরিতে ব্যস্ত চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তাঁরা জানান, এই দৈত্যাকারের প্রতিকৃতিই ফ্যাসিবাদের প্রতীক।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার এটিই প্রধান মোটিফ বা অবকাঠামো। এর সঙ্গে আরও চারটি মোটিফ রয়েছে। যেমন- জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’, সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের কাঠের বাঘ, শান্তির পায়রা আর জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদ মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতল। সব কটি মোটিফের নির্মাণকাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বলতে গেলে বাঁশ-কাঠের কাজ প্রায় শেষ। এখন কাগজ, চট বা কাপড় বসিয়ে তাতে রং লাগিয়ে চূড়ান্ত করা বাকি।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের কর্মব্যস্ততা। শিল্পকর্ম নির্মাণ ও সেসব বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানালেন, ঈদের ছুটির পর আজ (গতকাল) থেকেই শুরু হয়েছে পূর্ণ উদ্যমের কাজ। এখন থেকে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দিন থেকে রাত অবধি বিরামহীন চলবে মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষঙ্গ নির্মাণের কাজ।
শিল্পকর্ম নির্মাণে ব্যস্ত ঢাবি চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মাহমুদুল হাসান জানান, ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। ইলিশ মাছ, বাংলার বাঘ ও পায়রার উচ্চতা হবে ১৬ ফুট।
শোভাযাত্রার সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা ঢাবি চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, চব্বিশের চেতনা ধারণ করে সমকাল, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। এ কারণে শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। বিগত বছরগুলোর মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেখানে তিনটি বড় মোটিফ ব্যবহার করা হতো, এবার সেখানে পাঁচটি মোটিফ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বলেন, এবারের শোভাযাত্রায় পাঁচটি বড় মোটিফের পাশাপাশি সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ের ছোট-বড় নানা মোটিফ যুক্ত হবে। থাকবে ঐতিহ্যবাহী পালকী, পাখা, সুলতানি আমলের মুঘল মিনিয়েচারভিত্তিক মুখোশ।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে এই শোভাযাত্রার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হওয়াতে এবার এই শোভাযাত্রাটির নাম নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। নাম পরিবর্তন করা হতে পারে কি না, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান এবারের আয়োজন নিয়ে ৯টি কমিটি ও উপকমিটি রয়েছে। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত থেকেই নাম চূড়ান্ত করা হবে।
এদিকে বৈশাখ উদ্যাপনের অন্যতম কার্যক্রম হিসেবে চারুকলার বকুলতলায় বাংলা বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তির ও নববর্ষবরণের সাংস্কৃতিক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এ অনুষ্ঠান; বেলা ৩টা থেকে নাচগানের এ আয়োজন চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। আর ১৪ এপ্রিল সকালে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় চারুকলার বকুলতলার মঞ্চে পরিবেশিত হবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘যাত্রাপালা’। প্রতি বছর চারুকলার শিক্ষার্থীদের অভিনয়ে এই যাত্রাপালা পরিবেশিত হলেও এবার একটা পেশাদার যাত্রা দল এই যাত্রাপালা পরিবেশন করবে।
এদিকে জানা গেছে, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির নকশা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হবে চারুকলা অনুষদের সীমানাপ্রাচীর। লোকশিল্পের মোটিফ ফুল-পাখি-লতাপাতা দিয়ে নান্দনিক করে তোলা হবে দেয়াল।