গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ বহনকারী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক মানবাধিকারকর্মীদের ওপর ইসরায়েলি সেনারা ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্যাতিতদের মধ্যে সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও রয়েছেন। এদিকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে গতকাল হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছে। সূত্র : আলজাজিরা, রয়টার্স, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, শাফাক নিউজ, এএফপি
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক মানবাধিকারকর্মীর মধ্যে যে কয়েকজনকে ইসরায়েল ছেড়ে দিয়েছে তাঁরা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার সুইডিশ মানবাধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। তুর্কি সাংবাদিক এরসিন সেলিক দেশে ফিরে স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, তিনি ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক গ্রেটা থুনবার্গকে নির্যাতনের সাক্ষী। সেনারা থুনবার্গকে মাটির ওপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং তাঁকে ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য করে। মুক্তি পাওয়া মালয়েশিয়ার মানবাধিকারকর্মী হাজওয়ানি হেলমি এবং যুক্তরাষ্ট্রের উইন্ডফিল্ড বিবার ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে একই কথা বলেন। তাঁরা উল্লেখ করেন, থুনবার্গকে ধাক্কা দেওয়া হয় এবং ইসরায়েলি পতাকা হাতে নিয়ে প্রদর্শন করতে বাধ্য করা হয়; যা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা। তারা সবার সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করেছে। হেলমি বলেন, ‘গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।’ উইন্ডফিল্ড বিবার বলেন, ‘একটা কক্ষে ইসরায়েলের উগ্র দক্ষিণপন্থি জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির প্রবেশ করার পর সেখানে ধাক্কা মেরে গ্রেটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।’ ইতালির সাংবাদিক লরেঞ্জো আগোস্তিনো বলেন, ‘গ্রেটা থুনবার্গ এক সাহসী নারী। বয়স মাত্র ২২ বছর। তাঁকে ইসরায়েলি পতাকায় মোড়ানো হয়েছে এবং একটি ট্রফির মতো প্রদর্শন করা হয়েছে।’ তুর্কি টেলিভিশন উপস্থাপক ইকবাল গুরপিনার বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে কুকুরের মতো ব্যবহার করেছে। তিন দিন আমাদের না খাইয়ে রেখেছে। পানি দেয়নি। আমরা টয়লেটে থাকা পানি খেতে বাধ্য হয়েছি। প্রচণ্ড গরমে আমরা সবাই পুড়ে যাচ্ছিলাম। এ অভিজ্ঞতা আমাদের গাজায় মানুষের কষ্ট সম্পর্কে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে।’ অন্যদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। জানা গেছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩৭ জনকে শনিবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন তুরস্কের নাগরিক।
মাদ্রিদে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ : দখলদার ইসরায়েলের হাতে জিম্মি ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও গাজায় চলমান যুদ্ধের প্রতিবাদে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে শনিবার ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এ বিক্ষোভে অংশ নেয়। প্রতিবাদকারীরা বিশাল একটি ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে মিছিল করে এবং গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানায়। তাদের অনেকেই এ যুদ্ধকে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সান্দ্রা বলেন, ‘হামাসের পরিস্থিতি জটিল। তাদের শুধু নিজেদের দাবি নয়, সাধারণ মানুষের কথাও ভাবতে হবে। কিন্তু যা আমাকে সবচেয়ে বেশি হতাশ করে, তা হলো একটি তৃতীয় শক্তিশালী দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) গাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে, অথচ তাদের মতামতই চাওয়া হচ্ছে না।’ প্রতিবাদকারী লরা মার্তিনেজ বলেন, ‘খুব নিরাশ লাগছে। যখন মানবিক সাহায্যবাহী ফ্লোটিলা রওনা দিয়েছিল, আমরা সবাই তাদের সাফল্য কামনা করেছিলাম। কিন্তু ইসরায়েলি অভিযানে যা ঘটল, তা ভীষণ হতাশাজনক। সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে, এ বর্বরতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলতে হবে। সবাইকে তা করতে হবে।’
যুদ্ধ নিয়ে যা বলেন ট্রাম্প : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল ঘোষণা দিয়েছেন, ‘হামাস সম্মতি দিলেই গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।’ গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময়ের আলোচনায় বড় অগ্রগতি হয়েছে দাবি করে ট্রাম্প তাঁর নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লেখেন, ‘ইসরায়েল প্রাথমিক প্রত্যাহার সীমারেখায় যেতে সম্মত হয়েছে। এখন হামাস নিশ্চিত করলে যুদ্ধবিরতি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। শুরু হবে বন্দি ও কয়েদিবিনিময় এবং পরবর্তী ধাপের সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। আর এটিই আমাদের ৩ হাজার বছরের এ বিপর্যয়ের অবসানের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে।’
হামাসের ঘোষণা : আলোচনার পর দখলদার ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে চুক্তি তাৎক্ষণিক কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। হামাসের এক জ্যেষ্ঠ নেতা গতকাল বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনা করে হামাস যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি এবং জিম্মিদের তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে রাজি। দখলদাররা যেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ প্রস্তাবে বাধা না দেয়। যদি ইসরায়েলি দখলদাররা সত্যিকার অর্থে চুক্তি করতে চায়, তাহলে হামাস প্রস্তুত।’
স্বাগত জানাল আট মুসলিম দেশ : গাজা যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনায় হামাসের সম্মতি জানানোকে স্বাগত জানিয়েছে আটটি আরব ও মুসলিম দেশ। তারা এ পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল যৗথ বিবৃতিতে মিসর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ সমর্থনের কথা জানান। বিবৃতিতে তাঁরা ট্রাম্পের প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানান। পাশাপাশি হামাসের সঙ্গে বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়া শুরু করার কথাও বলেন। তাঁরা ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের প্রশংসা করেন। মন্ত্রীদের মতে এটি গাজার বেসামরিক জনগণের মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলা এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য একটি বাস্তব সুযোগ। বিবৃতিতে আট দেশ যুদ্ধ অবসান, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধাহীনতা, সাধারণ মানুষের সুরক্ষা, জোরপূর্বক বাস্তচ্যুতি রোধ এবং সব বন্দি মুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।