জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের চরমদন্ড (মৃত্যুদন্ড) চেয়েছে প্রসিকিউশন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গতকাল পঞ্চম দিনে প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এ আর্জি জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। দন্ডের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, কমপক্ষে ১৪০০ মানুষকে হত্যার দায়ে তার (শেখ হাসিনা) ১৪০০ বার ফাঁসি হওয়া উচিত। তবে একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের এই ভিকটিমদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে যদি চরম দন্ডটা দেওয়া হয়। এই আসামিরা (শেখ হাসিনা-আসাদুজ্জামান কামাল) অনুকম্পার অযোগ্য। এ ছাড়া জুলাই গণ অভ্যুত্থানে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য আসামিদের সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে বলে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করেন।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পাশাপাশি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও এ মামলার আসামি। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় চিফ প্রসিকিউটরকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম। উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, আবদুস সোবহান তরফদার, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। গতকাল কার্যক্রমের শুরুতেই প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম এ মামলায় তিন নম্বর অভিযোগ রংপুরে আবু সাইদ হত্যার বিষয়ে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। মিজানুল ইসলামের বক্তব্য শেষ হলে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এর ৪(১) এবং ৪(৩) পড়ে শোনান। রোম স্ট্যাটিউট-এর অনুচ্ছেদ ২৮ তুলে ধরেন। এ আইনে শেখ হাসিনার কমান্ড রেসপনসিবিলিটি কীভাবে প্রমাণিত হয়েছে তিনি তা উপস্থাপন করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ওয়াইড স্প্রেড অ্যাটাক কিংবা সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাক যেকোনো একটি প্রমাণিত হলেই মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, তাপস, ইনু এবং মাকসুদ কামালের সঙ্গে কথোপকথন থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়েছে সারা দেশে সব হামলার ব্যাপারে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত ছিলেন। তিনি সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তাজুল যুক্তিতর্কে বলেন, রাষ্ট্রের পুরো ফোর্সকে শেখ হাসিনা ব্যবহার করেছেন। শুধু সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেননি। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নির্বিচার হত্যাকান্ডে জনগণের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনগণ তাদের ফুল দিয়েছে, চুমু খেয়েছে। শুধু কোটা আন্দোলন দমন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের নৃশংসতার উদ্দেশ্য ছিল, হাসিনাকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছিলেন সর্বোচ্চ কমান্ড তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে। তার বাসায় প্রতি রাতে কোর কমিটির বৈঠক হতো। তিনি আইজিপিকেও নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তিনি বলতে পারেন না যে, তিনি জানতেন না। এরপর প্রধান কৌঁসুলি জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ ও ৫০ ধারা এবং রোম স্ট্যাটিউটের ২৫(৩) অনুচ্ছেদ তুলে ধরেন। জেনেভা কনভেশনের ৮৭ ধারায় আদেশকারীর দায়িত্বের কথা বলা হয় এবং তা তিনি পড়ে শোনান।
তাজুল ইসলাম কমান্ড রেসপনসিবিলিটির ওপর আন্তর্জাতিক আদালতের কয়েকটি রায় ও সিদ্ধান্ত পড়ে শোনান। এ সময় ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি জেনারেল তোমোয়ুকি ইয়ামাশিতার যুদ্ধাপরাধের মামলাসহ তিনটি মামলার অংশ পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ওইসব মামলায় যেভাবে ওয়াইড স্প্রেড এবং সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাক প্রমাণ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছভাবে এখানে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, দেশব্যাপী কমপক্ষে ১৪০০ জন নিহত এবং ২৫ থেকে ৩৫ হাজার আহত হয়েছেন। একজনের জন্য একবার মৃত্যুদন্ড হলে তার (শেখ হাসিনা) ১৪০০ বার ফাঁসি হওয়া উচিত। তবে একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের এই ভিকটিমদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে যদি তাকে চরম দন্ডটা দেওয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ৫ আগস্ট অপরাধ সংঘটনের পর পালিয়ে গেলেও ভারত থেকে ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এতে বোঝা যাচ্ছে- তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। তাই তাকে আইনানুযায়ী চরম দন্ড দেওয়া শ্রেয়। কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ এ আইনে নেই।
আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনার আদেশগুলো তিনি সবাইকে পৌঁছে দিয়েছেন। লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। কমান্ডার অব দ্য গ্রাউন্ড হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনিও অনুকম্পা পাওয়ার যোগ্য নন। তার বিষয়েও চরমদন্ড আমরা প্রার্থনা করছি।