মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) মেয়াদে এই লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর থাকবে। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই হার ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না।
গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ সময় সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান, নুরুন নাহার, কবির আহমেদ, চিফ ইকোনমিস্ট, বিএফআইইউ প্রধান, মুখপাত্র, সহকারী মুখপাত্রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গভর্নর জানান, ‘মূল্যস্ফীতি এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমরা চাই সেটি ধীরে ধীরে ৩ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে। তবে এটা সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।’
গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, তবে মে মাস পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং জুন শেষে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।
সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং জুন পর্যন্ত ১৮ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে মোট ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়েছে।
আর্থিক সংকটের কারণে এক-চতুর্থাংশ ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোও ঋণ বিতরণের পরিবর্তে সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগেই এখন বেশি মনোযোগী। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছিল গত অর্থবছরে।
মুদ্রানীতিতে নীতিগত সুদহার বা রেপো রেট আগের মতো ১০ শতাংশেই বহাল রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত এই হার কমানো হবে না বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) হার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) হার ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে।
গভর্নর জানান, ‘রেপো হার বাড়ালে তারল্য সংকুচিত হয়, যা বিনিয়োগে কিছুটা প্রভাব ফেললেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।’ মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের তুলনায় সামান্য বেশি। ডলার কেনার মাধ্যমে বাজারে অতিরিক্ত টাকা সরবরাহ এবং কিছু দুর্বল ব্যাংকে সহায়তা দেওয়ার কারণেই বাজারে মুদ্রার প্রবাহ বেড়েছে। গভর্নর বলেন, নমনীয় বিনিময় হার নীতিতে অটল থাকলেও অতিরিক্ত অস্থিরতা দেখা দিলে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে প্রতিদিন দুবার রেফারেন্স এক্সচেঞ্জ রেট প্রকাশ করা হচ্ছে, যা বাজারে স্বচ্ছতা আনতে ভূমিকা রাখছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুনে মাসিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালের পর সর্বনিম্ন। তবু গত অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, কঠোর মুদ্রানীতির ফলে মূল্যস্ফীতি ধাপে ধাপে কমবে এবং লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে পৌঁছানো সম্ভব হবে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হবে। যেসব ব্যাংক বারবার সহায়তা নিয়েও উন্নতি করতে পারেনি, তাদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ চালের মূল্যবৃদ্ধিকে অপ্রত্যাশিত বলে উল্লেখ করে গভর্নর জানান, সরকার ৪ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়ায় আছে। প্রয়োজন হলে ১৪ লাখ টন আমদানি করা হতে পারে।
চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী যে এটি ভবিষ্যতে বাড়বে। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে চাঙা রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতের দিক থেকে প্রায় চোখ সরিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
মুদ্রানীতির লক্ষ্য কী হওয়া উচিত জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে. মুজেরী বলেন, ‘নিশ্চয়ই মূল্যস্ফীতি কমানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং সেটির প্রতি সংস্থাটি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় দেশের কোনো খাতই ঠিকমতো চলছে না। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। তিনি আরও বলেন, ‘যাদের ঋণ বর্তমানে খারাপ অবস্থায় আছে, তাদের জন্য উপযুক্ত নীতিসুবিধা দিতে হবে। একই সঙ্গে সুদহার যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। শুধু কড়াকড়ির মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করা সম্ভব নয়।’