রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী নীতি বাস্তবায়ন না করার আহ্বান জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। তারা বলেন, শেখ হাসিনার মতো ভুল করবেন না। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো নীতি বাস্তবায়ন করার সাহস করবেন না। অবিলম্বে প্রতিবেদনসহ নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল ঘোষণা করুন। দুই মাসের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের নামে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন। শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করুন।
গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে অনুষ্ঠিত হেফাজত ইসলামের জনাকীর্ণ মহাসমাবেশ থেকে এসব দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া এসব দাবি বাস্তবায়নে সমাবেশ থেকে কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আগামী ২৩ মে বাদ জুমা চার দফা আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল এবং তিন মাসের মধ্যে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান। এর আগে সকাল ৯টার আগে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এরপর শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকার চারপাশের সব সড়কে নেতা-কর্মীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। সকাল ৯টায় হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মহাসমাবেশস্থলে পৌঁছান। শাপলা চত্বরে মারা যাওয়া মাওলানা ইউনুছ মোল্লার বাবার বক্তব্যের মাধ্যমে মহাসমাবেশের উদ্বোধন করা হয়। বেলা সোয়া ১টার দিকে দোয়া মোনাজাতের মধ্য দিয়ে মহাসমাবেশ শেষ হয়। বাদ ফজর থেকে দেশের জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন হেফাজতকর্মীরা।
চার দফা দাবিতে এই মহাসমাবেশের আয়োজন করে হেফাজত। এর মধ্যে প্রধান দাবি হলো- নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোরআন-সুন্নাহবিরোধী প্রতিবেদনসহ কমিশন বাতিল করা। এ ছাড়া সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল। ফ্যাসিবাদের আমলে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যাসহ সব হত্যার বিচার। ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম গণহত্যা এবং নিপীড়ন বন্ধে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা।
মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরী। অতিথি হিসেবে বক্তব্যে দেন দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। এ ছাড়া হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাহমুদুর হাসান কাশেমী ও আহমেদ কাশেমী, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, কেন্দ্রীয় সদস্য মাহমুদ বিন হোসাইন, তাহরিকে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের আমির ড. মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী পীর জৈনপুরীসহ হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও মুফতি কেফায়েত উল্লাহ আজহারী। মহাসমাবেশের ১২ দফা ঘোষণাপত্র তুলে ধরেন হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক। কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান।

হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, দেশে ইসলামবিরোধী গোষ্ঠী আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সাম্রাজ্যবাদের ফান্ডখোর কুখ্যাত নারীবাদীরা এদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, বিধি-বিধান, ঐতিহ্য ও পরিবারকাঠামো ধ্বংস করার পাশ্চাত্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না- যা কোরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে যায়। এক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দেব না। তিনি এই বিতর্কিত কমিশন ও কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার আলেম-ওলামার পরামর্শ নিয়ে নতুন কমিশন গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, দেশের যৌতুকপ্রথা বন্ধে কঠোর আইন করুন। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু-কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারও নেই। তাই ধর্ম অবমাননার শাস্তির আইনি ধারাগুলো বহাল রেখে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ওই নির্দিষ্ট সুপারিশগুলো বাদ দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-এর নামে কটূক্তি বা বিষোদ্গার বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করতে হবে।
সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলা যাবে না। দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি নিউইউর্কের গোলামি করার জন্য নয়। এই অপতৎপরতা বন্ধ না হলে দেশপ্রেমিক জনতাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেন, একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধারা বলেছিলেন, আমরা পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। ২৪-এর জুলাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর আমি বলতে চাই, আমরা দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি নিউইউর্কের গোলামি করার জন্য নয়।
মহাসমাবেশে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, হেফাজতে ইসলাম নারীবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমি এখানে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা কেন অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করছেন? আমি বলতে চাই, নারী কমিশন তৈরির জন্য জুলাই বিপ্লবে কেউ জীবন দেয় নাই। তারা জীবন দিয়েছিল এদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করার জন্য। কাজেই আপনারা সরকারে বসেছেন যাতে করে বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের আগ্রাসন মুক্ত করার জন্য। আমি মনে করি আপনাদের দায়িত্ব শুধু সে সংস্কারগুলো করা- যে সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে পারবে না। মাহমুদুর রহমান বলেন, আমরা দেখেছি, আপনারা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছেন- যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। আপনারা রাষ্ট্রের সময় এবং সম্পদ নষ্ট করছেন। সুতরাং আমার অনুরোধ- আপনারা এই সমস্ত কমিশন বাতিল করে দেন। আমাদের এই সমস্ত কমিশনের প্রয়োজন নাই।
জাতীয় নাগরিক পার্টির-(এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, নারী সংস্কার কমিশনের ইসলামবিরোধী সুপারিশ বাতিল করতে হবে। আওয়ামী লীগকে ৫ আগস্ট জনগণ লালকার্ড দেখিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন মেনে নেওয়া হবে না।
ড. মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী পীর জৈনপুরী বলেন, বাক-স্বাধীনতার নামে যেই ইসলামের বিরোধিতা করবে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গি তকমা দিয়ে আমার দেশের আলেম ওলামাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। বাবর সাহেব যদি মুক্তি পায় তাহলে জঙ্গির মামলায় আলেম ওলামারা কেন মুক্তি পাবে না। যদি তারা মুক্তি না পায় তাহলে শুধু সংস্কার কেন নির্বাচন পর্যন্ত হতে দেওয়া হবে না।
মহাসমাবেশের ১২ দফা ঘোষণাপত্রের মধ্যে রয়েছে, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তাদের কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিলপূর্বক আলেম-ওলামার পরামর্শক্রমে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারীসমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন করা।
নারীর সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা মূল্যবোধ নয় বরং আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকেই বাস্তবমুখী সংস্কারের দিকে যেতে হবে। এ ছাড়াও আছে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন করতে হবে এবং ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ইমান-আমল রক্ষার্থে ‘বহুত্ববাদ’ নামক আত্মঘাতী ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। ‘লিঙ্গ বৈচিত্র্য’, ‘লিঙ্গ সমতা’, ‘লিঙ্গ বৈষম্য’, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ (বা থার্ড জেন্ডার), ‘অন্যান্য লিঙ্গ’ ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে, ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’ এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগানের অন্তরালে এবং অসংজ্ঞায়িত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ (বা ‘ইনক্লুসিভ’) ইত্যাদি শব্দের আড়ালে এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজবিধ্বংসী ও ধর্মবিরুদ্ধ সমকামীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে। শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার চিহ্নিত দোসরদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে।