ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানে আঘাত হানার বিষয়ে সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুসারে বলেছে, তারা আর মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় হামলার আশঙ্কা করছে। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা, ডন, এনডিটিভি, এএফপি।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, সামরিক পর্যবেক্ষকরা যে কোনো মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। এ বিষয়ে মঙ্গলবার পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারত আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে।’ তার এই বক্তব্যের পর ২৪ ঘণ্টা চলে গেছে। হাতে রয়েছে আর মাত্র ১২ ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যে ভারত সত্যি সত্যিই পাকিস্তানের ওপর হামলা শুরু করবে কি না- সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও যুদ্ধের সব রকম প্রস্তুতির খবর পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পূর্ব নির্ধারিত রাশিয়া সফর বাতিল করেছেন। আগামী ৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য রাশিয়ার রাজধানী মস্কো যাওয়ার কথা ছিল তার। এ বিষয়ে গতকাল রাশিয়ার তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এই অনুষ্ঠানে আসছেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার বদলে রাশিয়ার এ অনুষ্ঠানে ভারতের তরফ থেকে থাকতে পারেন কূটনৈতিক প্রতিনিধি। খবরে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লিতে এখন একের পর এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক চলছে। গতকাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কমিটিকে নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর আগের দিন তিনি সেনা সর্বাধিনায়ক এবং তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে বৈঠক করেন। গতকাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে নিয়ে বৈঠক হয়। এসব বৈঠক থেকেই সেনা বাহিনীকে যুদ্ধ শুরু ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী, বৈঠকগুলোতে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বলা হয়, পাকিস্তান পুরোপুরিভাবে চীনা অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে ভারতের কাছে রয়েছে, রাশিয়া ও ইসরায়েলসহ দেশীয় প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও লেজার অস্ত্র। যুদ্ধ শুরু হলে ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান হামলা আটকানোর জন্য ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে ছয়টি করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল হাতিয়ার রাশিয়ার তৈরি এস ৪০০ ট্রায়াম্ফ। সীমান্তে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকাকে অভেদ্য বর্মে ঢেকে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে এই অস্ত্রের। শত্রুর ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা যুদ্ধবিমানকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে পারবে এস-৪০০। শুধু তা-ই নয়, এর ‘অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে’ বা এইএসএ রাডারের সাহায্যে একসঙ্গে ৩০০ টার্গেট চিহ্নিত করা যাবে। এস-৪০০ ট্রায়াম্ফে স্বল্প, মাঝারি এবং দূরপাল্লার মিলিয়ে মোট তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। শব্দের চেয়ে ১৪ গুণ গতিতে ছুটতে পারে এগুলো। অন্য দিকে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পাক বাহিনীর হাতে রয়েছে চীনের তৈরি এইচকিউ-৯পি/এইচকিউ-৯বিই। ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারবে এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই হাতিয়ারেও রয়েছে এইএসএ রাডার। পাশাপাশি এস-৪০০-এর মতো এতেও ১৪ ম্যাক গতির ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা দিয়ে মাঝআকাশে লড়াকু জেট বা ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করা সম্ভব। বৈঠকের বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়, ভারত-রুশ যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রকে আটকাতে চীনের এলওয়াই-৮০/এলওয়াই-৮০ই নামের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর পাকিস্তান ভরসা করছে। কিন্তু শব্দের তিন গুণের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে পারা ব্রহ্মোসকে ঠেকানো সম্ভব হবে না। ফলে যুদ্ধ বাধলে চীনের জেএফ-১৭-এর ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে হবে পাক বিমানবাহিনীকে। কিন্তু সাড়ে চার প্রজন্মের যুদ্ধবিমান জেএফ-১৭কে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করতে ভারতের হাতে রয়েছে দেশীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর তৈরি আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। ৭০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত নিশানায় হামলা করার ক্ষমতা রয়েছে এই হাতিয়ারের। এ ছাড়া ভারতীয় বিমান বাহিনীতে রয়েছে ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান। এই বিমান থেকে জেট স্কাল্প নামের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা ঠেকানোর জন্য পাকিস্তানের রয়েছে চীনের তৈরি এফএম-৯০। এটি মাত্র ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। কিন্তু যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করার ক্ষমতা এর নেই। বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, সীমান্তে ১৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলি স্পাইডার হাতিয়ার ব্যবহার করছে ভারতীয় সেনারা। এতে রয়েছে পাইথন-৫ এবং ডার্বি ক্ষেপণাস্ত্র। ফ্রান্সের তৈরি ক্রোটালে নামের অনুরূপ একটি ব্যবস্থা রয়েছে পাক ফৌজের হাতেও। তবে সেটি বেশ পুরোনো।
জাতিসংঘের সহায়তা চাইলেন শাহবাজ : ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে নয়াদিল্লিকে দায়িত্বশীল আচরণ ও সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে অনুরোধ জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। খবরে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে এক ফোনালাপে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। গতকাল দুই নেতার এ আলাপে দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর আলোকপাত করা হয়।
গুতেরেসের সঙ্গে আলাপে শাহবাজ বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত মঙ্গলবার থেকে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। ঘটনার পরপরই কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভারত ওই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানায়। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের বড় ত্যাগের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
গুতেরেসকে শাহবাজ বলেন, সিন্ধু অববাহিকার পানিকে অস্ত্র বানানোর ভারতের প্রয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। এ অববাহিকার পানিকে ২৪ কোটি পাকিস্তানির জীবনীশক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত কোনো দুর্ভাগ্যজনক আচরণ দেখালে, এর জবাবে পাকিন্তান তার সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি ভারতকে সংযত আচরণ করার পরামর্শ দেওয়ার ও নিরাপত্তা পরিষদের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবগুলো অনুযায়ী কাশ্মীর সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধানে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
যুদ্ধ বিমানের মহড়া : কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মহড়া দিতে গিয়ে মঙ্গলবার রাতে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান মুখোমুখি হলেও কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি।
তবে পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিডিএফ) দাবি করেছে, পাকিস্তানি বিমানের উপস্থিতি দেখে পালিয়ে গেছে ভারতের ৪টি রাফাল যুদ্ধবিমান। পিডিএফ দাবি করে, ভারতীয় বিমানগুলো দেখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তানের কয়েকটি ইউনিট। এর ফলে সেগুলো পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ইসলামাবাদের একটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, ভারতীয় রাফাল বিমানগুলো ভারতীয় অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের আকাশসীমায় টহল দিচ্ছিল। তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনী দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালে সেগুলো পিছু হটতে বাধ্য হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তা : কাশ্মীর ঘিরে নতুন করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কূটনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র। পরিস্থিতি শান্ত করতে আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, আমরা উভয়পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং স্পষ্টভাবে জানাচ্ছি, যেন কেউ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে না করে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা পুরো পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং উভয় দেশের সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে।
যুদ্ধ কি সত্যিই শুরু হচ্ছে : পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের এমন টানাপোড়েনে আবারও দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর রাষ্ট্র এ উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানালেও পরিস্থিতি ক্রমেই সংঘাতমুখী হয়ে উঠছে। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ভারত এখন কেবল প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে নেই, বরং পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের সক্রিয় প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরেক খবরে বলা হয়, ভারতের দিকে তাক করা আছে পাকিস্তানের ১৩০টি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র। ঘোরি, শাহিন, গজনবি মিসাইল প্রস্তুত রয়েছে এবং যে কোনো ভারতীয় আগ্রাসনের জবাব দিতে তারা সর্বাত্মক প্রস্তুত আছে। বিশেষ করে যদি ভারত সিন্ধু নদের পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে পাকিস্তান যুদ্ধের পথে হাঁটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কৌশলগত জোটের দিক থেকে ভারত বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে রয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইসরায়েল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রতি বেড়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ঐতিহ্যগতভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন সমর্থন পেলেও তা সীমিত। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) পাকিস্তানের সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ভারত কোয়াড জোটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে আঞ্চলিক ভারসাম্য তৈরি করছে। সব মিলিয়ে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি এবং পাকিস্তানের পাল্টা হুমকি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় সংঘাতের সম্ভাবনাকে উসকে দিচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, একটি সামান্য ভুল হিসাব কিংবা ভুল বোঝাবুঝি বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।