গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হওয়ার পর এবার গুম প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশের খসড়াও প্রস্তুত করছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে প্রস্তাবিত এই আইনে গুমের সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে গুমের ফলে মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। পাশাপাশি রাখা হয়েছে ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে গুমের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ রাখা রয়েছে। আইনটি জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য নয়! আইনের খসড়ায় গুম অপরাধের বিচারে গুম প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল নামে পৃথক আদালত এবং তদন্তের জন্য আলাদা তদন্ত সংস্থা গঠনের বিধানও যুক্ত করা হয়েছে। গুম অপরাধ ঠেকাতে জাতীয় গুম প্রতিরোধ কমিশন নামে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত এ আইনের ওপর অংশীজনদের মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল রাজধানীর বিচার প্রশাসন ইনস্টিটিউটে প্রস্তাবিত আইনের ওপর মতামত গ্রহণে একটি মতবিনিময় সভারও আয়োজন করা হয়। এ মতবিনিময় সভায় খসড়ার ভুলত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিস্তারিত মতামত প্রদানে অংশীজনদের সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গুম প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলেন, এ আইন হলে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিতি পাবে। তবে শুধু আইন করলে হবে না। আইন কার্যকরের উদ্যোগও নিতে হবে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগ নিয়ে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সমালোচনা রয়েছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দিশালা থেকে দীর্ঘ সময় পর বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মুক্ত হওয়ার পর গুমের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। এই পরিস্থিতিতে গত বছর ২৯ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এ সনদে যুক্ত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের জন্য সরকার বা এর যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে জাতিসংঘ।
এর আগে ২৭ আগস্ট বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত করছে। সর্বশেষ এ কমিশনের প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।
এ কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে কমিশনে ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে কমিশন। এতে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন ব্যক্তি) এখনো নিখোঁজ।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে কোনো যুক্ত হওয়ার পর এ ধরনের একটি আইন করা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম দায়িত্ব। যখন কোনো আন্তর্জাতিক সনদে কোনো দেশ যুক্ত হয়, তখন ওই ধরনের অপরাধকে নিজেদের দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা সনদ মেনে চলার অংশ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদ আমলে যেভাবে গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে, এখনো অনেক মানুষ ফিরে আসেনি। সেই সব ঘটনার বিচারও হয়নি। এই অপরাধগুলোর বিচারে এই আইনটা জরুরি ছিল। শুধু আইন করলেই হবে না, আইনের বাস্তবায়নও প্রয়োজন। এ আইন হলে আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সভ্য জাতি হিসেবে চিহ্নিত হব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।