বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। দেশ থেকে যত অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে, তার প্রায় ৭৫ শতাংশই বাণিজ্যিক চ্যানেলের মাধ্যমে হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রবাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)।
গতকাল রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম কার্যালয়ে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার প্রতিরোধে নির্দেশিকা বাস্তবায়নের অবস্থা শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনের পর কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মোট ৯৫টি বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচারের মামলা করেছে, যেখানে পাচারের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা বা ৩২ কোটি মার্কিন
ডলার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে শুধু ভুয়া ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে, যা বর্তমানে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ এবং বাংলাদেশের বার্ষিক স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়েও বেশি। ২০২৪ সালে হালনাগাদ জিএফআইর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটির হোয়াইট পেপারে বলা হয়, ২০০৯-২০২৩ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশের সমান। সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে পোশাক ও ভোগ্যপণ্য আমদানির মাধ্যমে। বিআইবিএম বলছে, বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচারের কারণে সরকারের শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে বাজেট বরাদ্দ সংকুচিত হয়। এ ছাড়া ভুল বাণিজ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত শিল্প নীতিও সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) সতর্ক করে বলেছে, যারা বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার দমন করতে ব্যর্থ হয়, তাদেরকে গ্রে-লিস্ট করা হয়, ফলে ব্যাংক লেনদেন ব্যয় বাড়ে, রপ্তানিকারকরা ক্রেডিট সুবিধা হারায় এবং বিনিয়োগ পরিবেশ নষ্ট হয়।
শৃঙ্খলায় দুর্বলতা; নীতির চেয়ে বাস্তবায়নে বেশি ঘাটতি : প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার প্রতিরোধে নীতিগত অগ্রগতি থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে একাধিক সীমাবদ্ধতা। মূল্য যাচাইয়ের প্রযুক্তি ও প্রকৃত বাজার তথ্য নেই অনেক কাস্টমস অফিসে। ট্যাক্স, ব্যাংক ও কাস্টমস ডেটাবেস সমন্বিত নয়। ফ্রি-ট্রেড জোন ও শেল কোম্পানি ব্যবহারে লেনদেন গোপন রাখা সম্ভব হয়। স্বচ্ছ মালিকানা তথ্য সংরক্ষণ দুর্বল ও খণ্ডিত। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাস্টমস ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মধ্যে তথ্য বিনিময় প্ল্যাটফর্ম তৈরি, ব্যাংকে ট্রেড ফাইন্যান্স ও ঋণ অনুমোদনে স্বচ্ছতা ও যাচাই বাড়ানো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশাল তথ্য ভান্ডার ব্যবহার করে বাণিজ্য পর্যালোচনায় প্রযুক্তি-নির্ভরতা বাড়ানো দরকার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আঞ্চলিক ফোরামে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার রোধে তথ্য বিনিময় বাড়ানো ও ফ্রড কোম্পানি শনাক্তে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ ও ডিজিটাল ট্রেড পোর্টাল ও ই-ইনভয়েসিং বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছে বিআইবিএম। এসব প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই, এটি এখন আর বিকল্প নয়, একটি জাতীয় অগ্রাধিকার।