নেলপলিশ সৌন্দর্যের জগতে বহু পুরোনো সঙ্গী। প্রাচীন রাজবংশের শাসক থেকে শুরু করে হলিউড তারকা- আর আজকের আধুনিক সেলুনের তাকেও তার উপস্থিতি সমানভাবে লক্ষ করা যায়। কিন্তু নখে রং লাগানোর এই যাত্রা শুরু হলো কীভাবে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কীভাবে বদলেছে? সে ইতিহাসে চোখ বুলাই...
হাজার বছর আগে থেকে মানুষ নখে রং লাগিয়ে শুধু সৌন্দর্য প্রকাশ করেনি, বরং তা দিয়ে সামাজিক অবস্থানও বুঝিয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে প্রাচীন চীনে প্রথম নখে রং ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এটি ছিল রাজকীয় সৌন্দর্যচর্চার একটি অংশ। মৌমাছির মোম, ডিমের সাদা অংশ, জেলাটিন এবং উদ্ভিজ্জ রং ব্যবহার করে তৈরি হতো সে সময়ের ফর্মুলা। তবে নখ রাঙানো শুধু সৌন্দর্য বাড়ানো ছিল না- ছিল প্রতীকীও। প্রাচীন মিসরে অভিজাতরা হেনা ব্যবহার করে নখ রাঙাত, গাঢ় লাল রং ছিল উচ্চপদস্থদের জন্য, তন্মধ্যে ফারাওরাও ছিলেন। আর ক্লিওপেট্রার প্রিয় রং ছিল রক্ত লাল। তিনি হাতজুড়ে বাহারি নকশা করার বদলে শুধু নখে হেনা ব্যবহার করতেন।
যদিও প্রাচীন সভ্যতায় নখ রাঙানো ছিল ক্ষমতার প্রতীক, তবে আধুনিক নেলপলিশের যাত্রা শুরু হয় অনেক পরে। ফ্রান্সে ম্যানিকিউরের কৌশল শিখে মেরি ই. কাব তা আমেরিকায় নিয়ে আসেন এবং ১৮৭৮ সালে খোলেন বিশ্বের প্রথম নেল সেলুন- ‘Mrs. Pray's Manicure।’ তিনি এখানেই থামেননি, নিজের পণ্য তৈরি করেন, ঘরে বসে ম্যানিকিউরের গাইড প্রকাশ এবং এমেরি বোর্ড বা নেল ফাইল আবিষ্কার করে স্থায়ী অবদান রাখেন। ১৯১১ সালে Cutex বাজারে আসে, যা শুরুতে কিউটিকল নরম করার পণ্য ছিল কিন্তু ১৯২৫ সালে তারা তৈরি করে তরল নেলপলিশ। ১৯২০ সালে ফরাসি মেকআপ আর্টিস্ট মিশেল মেনার্ড গাড়ির রং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেন নেল ল্যাকার, যা ছিল যুগান্তকারী আবিষ্কার। এতে নখে আসত উজ্জ্বল, টেকসই এবং ফ্যাশনেবল ফিনিশ। ১৯৩০ সালে বড় বড় প্রসাধনী ব্র্যান্ডগুলো কাচের বোতলে তুলিসহ নেলপলিশ বাজারজাত করতে শুরু করে। লাল এবং গোলাপি রং হয়ে ওঠে সিগনেচার শেড, যা ছিল গ্ল্যামারাস হলিউড যুগের নারীদের পছন্দের শীর্ষে।
পরবর্তীতে নেলপলিশ শিল্পে বড় পরিবর্তন আসে। ১৯৫৪ সালে ডেন্টিস্ট ফ্রেড স্ল্যাক নিজের ভাঙা নখ মেরামত করতে ডেন্টাল উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করেন প্রথম অ্যাক্রিলিক নখ, যা কৃত্রিম নখের যুগের সূচনা করে। ১৯৮০ সালের দিকে আসে নেল র্যাপস ও জেল পলিশ। লিনেন বা সিল্কের নেল র্যাপস ছিল তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর, আর জেল পলিশ নখ ভেঙে যাওয়ার সমস্যা কমালেও তখন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, কারণ এর কিউরিং পদ্ধতি সহজ ছিল না। তবে কয়েক দশক পরে অবশ্য এটি চাহিদাসম্পন্ন বিকল্প হয়ে ওঠে। আর নখের নকশার ইতিহাসে ১৯৭৫ সালও গুরুত্বপূর্ণ। জেফ পিঙ্ক, আমেরিকান মেকআপ আর্টিস্ট ও Orly-এর প্রতিষ্ঠাতা, এমন নকশা খুঁজছিলেন যা যে কোনো পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে যায়। তাঁর হাত ধরেই জন্ম নেয় বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিউর, যা দ্রুতই ফ্যাশন জগতে বিপ্লব ঘটায়। ১৯৮০-এর দশকে Essie Weingarten নিজের নেলপলিশ ব্র্যান্ড চালু করেন। ১৯৮৩ সালে জোয়ান রিভার্স টেলিভিশনে ‘Jelly Apple’ শেডের প্রশংসা করলে Essie পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে কেট মিডলটনের রাজকীয় বিয়েতে Essie-i 'Allure’ শেড ব্যবহৃত হওয়ায় এটি রাজকীয়তার প্রতীক হয়ে যায়। অন্যদিকে শ্যানেলের Rouge Noir বা Vamp চলচ্চিত্র Pulp Fiction-এ উমা থারম্যানের ব্যবহারের পর থেকে কাল্ট ক্লাসিক হিসেবে পরিচিতি পায়।
অন্যদিকে প্রথাগত নেলপলিশেও ছিল বিবর্তন। ২০শ শতকে নেলপলিশ শুকোতে এক ঘণ্টার বেশি সময় নিত এবং কয়েক দিনের মধ্যেই খসে পড়ত। এগুলোতে ব্যবহার হতো নাইট্রোসেলুলোজ, দ্রাবক, প্লাস্টিসাইজার, রেজিন, পিগমেন্ট এবং UV স্ট্যাবিলাইজার। ১৯৯০ সালে আবিষ্কার হয় UV টপ কোট, যা দ্রুত শুকিয়ে দিত। তারপর ২০০৭ সালে আসে প্রথম লং-ওয়্যার পলিশ, যা মাত্র পাঁচ মিনিটে শুকিয়ে ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকত। ২০০৯-২০১০ সালে রঙিন অ্যাক্রিলিক,UV জেল পলিশ ও Shellac™ বাজারে আসে। ২০১৩ সালে হাইব্রিড পলিশ, যা সূর্যের আলোতেই শুকিয়ে যায় এবং সহজে সরানো যায়। ডিপ সিস্টেম, প্রেস-অন নখ ও পলিশ স্ট্রিপও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পায়। এসব উদ্ভাবনের মূল প্রেরণা ছিল- সুবিধা, সময় সাশ্রয়, দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা।
এদিকে বাংলার নারীরা হাত-পা সাজাতে দীর্ঘকাল ধরে মেহেদি, আলতা ও প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করতেন। আর বিয়ে, উৎসব কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান- সব ক্ষেত্রেই নখ রাঙানো ছিল রূপচর্চারই অংশ। ব্রিটিশ শাসনামলে নগরজীবনে পাশ্চাত্য প্রভাব আসতে শুরু করে। তখন কলকাতা ও ঢাকার অভিজাত নারীরা নখে আধুনিক ধাঁচের রং ব্যবহার শুরু করেন। পাকিস্তান আমলের পর ৭০-৮০ দশকে স্বাধীন বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া নেলপলিশ জনপ্রিয় হতে থাকে। গ্লোবাল ব্র্যান্ড ও সস্তা দামের নেলপলিশ বাজারে আসায় মধ্যবিত্তের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে নেলপলিশ সৌন্দর্যের জনপ্রিয় অনুষঙ্গ।
লেখা : ফেরদৌস আরা