অব্যবস্থাপনায় জলুস হারাচ্ছে পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চরম ঘাটতি। রাস্তাঘাট, স্যুয়ারেজসহ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক বোতলসহ হরেক রকমের বর্জ্য। সৈকত বা রাস্তার পাশে কোথাও নেই বিন। লাখ লাখ পর্যটক বিভিন্ন খাবার খেয়ে প্যাকেট ফেলছে সৈকতে, রাস্তায়। প্লাস্টিক বর্জ্যে বন্ধ হয়ে গেছে স্যুয়ারেজগুলো। ঢেউয়ের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ভেসে যাচ্ছে সাগরে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্যও বিপদ ডেকে আনছে। এমনকি সৈকতের কাছেই অবস্থিত আইকনিক রেলস্টেশনটির অবস্থাও বেহাল। চরম অব্যবস্থাপনার জন্য উদ্বোধনের দুই বছর পার না হতেই নাজুক দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার স্টেশন। সরেজমিন দেখা গেছে এমন চিত্র।
২০২৩ সালের নভেম্বরে উদ্বোধন হয় কক্সবাজার রেলস্টেশন। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে স্টেশনের অধিকাংশ বাতি, দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। পরিষ্কার করা হয় না টয়লেট। ২৪ অক্টোবর রেলস্টেশনের টয়লেটে গিয়ে দেখা যায়, কমোড উপচে পড়ছে মানববর্র্জ্য।
হারিয়ে যাচ্ছে পর্যটনের অনন্য আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। জালিয়াপালং ইউনিয়নের বাইল্যাখালী অবস্থিত বিচটি একসময় লাল কাঁকড়ায় ভরা ছিল। এখন সেখানে কাঁকড়া দেখা যায় না বললেই চলে। পর্যটকরা এখন লাল কাঁকড়া দেখতে ছুটে যান টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। সরেজমিন শাহপরীর দ্বীপে অনেক পর্যটককে কাঁকড়ার পেছনে তাড়া করতে দেখা গেছে। ফারুক নামে এক পর্যটককে পলিথিনে কাঁকড়া ভরতে দেখা যায়। এগুলো কী করবেন-জানতে চাইলে বলেন, ‘বাচ্চারা খেলবে’। স্থানীয়রা বলছেন, পর্যটকদের নির্বিচার ধাওয়া ও ধরার কারণে লাল কাঁকড়া কমে গেছে। প্রশাসন কঠোর না হলে এগুলো হারিয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশগত অবহেলায় সেই সম্ভাবনা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটক নেই বললেই চলে। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ দেশি পর্যটক সৈকতে ভিড় করে। তাদেরও নানান অভিযোগ। হোটেলের অতিরিক্ত ভাড়া, দালালচক্রের উৎপাত, অপরিচ্ছন্নতা, সাগরের পানি ঘোলা, সৈকতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার অভাব। নারী পর্যটকের গোসলের দৃশ্য গোপনে ধারণ করে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। সৈকতে বা রাস্তায় কোনো বিন না থাকায় পর্যটকরা বাধ্য হয়ে যত্রতত্র বর্জ্য ফেলছে। ঢেউয়ের সঙ্গে এ বর্জ্যরে বড় অংশ সাগরে মিশছে, যা সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রায়ই সৈকতে ভেসে আসছে মৃত ডলফিন, জেলিফিশ ও কচ্ছপের দেহ।
কক্সবাজার থেকে শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, সাজেকসহ বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে গ্রুপ প্যাকেজে ভ্রমণের আয়োজন করেন নিহাদ মাহমুদ। ভ্রমণের নেশা থেকে ‘ট্যুর প্যাক’ নামে এজেন্সি চালু করে কম সময়েই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কক্সবাজার ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব। আমরা আমাদের পর্যটকদের জন্য গাড়িতে বিন রেখেছিলাম। যাত্রার আগে সবাইকে বলে দিতাম বর্জ্য বিনে রাখতে। কিন্তু ভ্রমণ শেষে বর্জ্য নিয়ে কক্সবাজারে এলে এগুলো ফেলার জায়গা পাওয়া যায় না। এরপর বিন রাখা বন্ধ করে দিয়েছি।’
এদিকে গভীর রাতে পৌরসভার ময়লার গাড়িতে বিভিন্ন হোটেল থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। বর্জ্যকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তাঁরা হোটেল থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করলেও ভ্রাম্যমাণ পর্যটকদের জন্য কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। শহরের কোথাও বিন নেই। মাঝেমধ্যে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা হয়। তবে অনেক বর্জ্য আশপাশের জমি, ড্রেন ও সাগরে চলে যায়। পর্যটকরা বলছেন, সৈকত ও শহরজুড়ে পর্যাপ্ত বিন স্থাপন, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালালে এবং যত্রতত্র বর্জ্য ফেললে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে কক্সবাজারের চিত্র বদলে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার পৌরসভার প্রশাসক শামীম আল ইমরান বলেন, ‘সৈকতে বিন দেওয়া হয়েছিল। চুরি হয়ে গেছে। বড় আকারের বিন বসিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না আলোচনা করে দেখব।’