রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা। হাসপাতাল, ফুটপাত, রেলস্টেশন বা ডাস্টবিনের পাশে প্রায় প্রতিদিনই মিলছে কারও না কারও নিথর দেহ। অক্টোবরে এ সংখ্যা ছিল ৬৬। হাসপাতালের মর্গে থাকা লাশের পরিচয় নিশ্চিত না হলে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে ঠাঁই হচ্ছে কবরে। ২০১০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১৫ বছরে ১৪ হাজার ৮৭৬ অজ্ঞাত মানুষের লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দাফন করা হয়েছে ৪৬৮ জনের লাশ।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অজ্ঞাত লাশ শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, এটি নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির সূচক হিসেবে গণ্য হয় অজ্ঞাত লাশ। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হিসাবে, শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে ৪৬৮ জনের লাশ। ২০২৩ সালের একই সময়ে ৩৭৮টি লাশ দাফন করা হয়। সংগঠনটি মাসে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে থাকে।
জানা গেছে, ২৪টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে এখনো রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরে ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ছিল ৫২। সব মিলিয়ে ১০ মাসে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা ৫৫৮টি।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তথ্য জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না
এমএসএফ
আঞ্জুমান মুফিদুলের দাফন সেবা কর্মকর্তা মো. কামরুল আহমেদ বলেন, পুলিশের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া কোনো লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে পারি না। লাশ বহনের জন্য আমরা খরচ নিই না। আমাদের নিজস্ব গাড়িতে করে সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে দাফন করি। তিনি আরও বলেন, ঢাকা উত্তরের জন্য রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও দক্ষিণের জন্য জুরাইন কবরস্থান নির্ধারণ করা আছে।
আঞ্জুমানের রেকর্ড অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৩৮৬, জুরাইন কবরস্থানে ৭৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী কয়েক অজ্ঞাত ব্যক্তির সৎকার করা হয়েছে পোস্তগোলা শ্মশানে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গের ইনচার্জ যতন কুমার বলেন, বর্তমানে আমাদের মর্গে অন্তত ছয়টি অজ্ঞাত লাশ আছে। এসবের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় ও পুলিশের নির্দেশনা না পাওয়ায় তা স্বজন কিংবা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে সরবরাহ করা যায়নি। একই চিত্র দেখা গেছে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। মিটফোর্ডের ইনচার্জ শ্যামল জানান, আজই (গতকাল) দুই অজ্ঞাত লাশ আঞ্জুমানে দেওয়া হয়েছে। আরও একটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে।
ঘাটে ঘাটে অবহেলা : অজ্ঞাত লাশ সাধারণত উদ্ধার করে থানার পুলিশ মর্গে পাঠায়। পরিচয় শনাক্ত না হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফন করে। পুলিশ ও হাসপাতালের মাঝে সমন্বয়ের অভাব, ব্যয়সংক্রান্ত জটিলতা এবং দীর্ঘ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া দাফনে বিলম্ব ঘটায়।
সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামলীর ফুটপাত থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারীর লাশ এই চিত্রকেই স্পষ্ট করে। ওই নারীর লাশ বহনের জন্য টাকা দিয়েছিলেন পথচারীরাই। মোহাম্মদপুর থানার এসআই শিরিন সুলতানা বলেন, পথে থাকা মানুষজন কেউ ১০০, কেউ ২০, কেউ ১০ টাকা করে দেয়। সেই টাকা দিয়ে লাশ মর্গে পাঠিয়েছি। কিন্তু ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও সেই নারীর ময়নাতদন্ত হয়নি, পরিচয়ও মেলেনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সব জায়গায়ই টাকা লাগে। আমি কি নিজের বেতনের টাকা দিয়ে ময়নাতদন্ত করাব? কেউ দায়িত্ব নেয় না। ট্রিপল নাইন লেখা গাড়ি দিয়েও লাশ তুলতে গেলে চালক টাকা ছাড়া নড়েনি। ১ হাজার ২০০ টাকা না দিলে লাশ তুলবে না বলে বসেছিল। তার ভাষায়, লাশটা মর্গে নামানোর পরও খামচাখামচি করে টাকা নিয়েছে। এই নারী এখনো পড়ে আছে ফ্রিজে। পোস্টমর্টেম না হওয়ায় আঞ্জুমানেও দেওয়া যাচ্ছে না।’
সূত্র বলছে, অজ্ঞাত লাশ পরিবহন ও মর্গে সংরক্ষণের জন্য পুলিশের বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকে। সেই বরাদ্দের টাকা অনেক সময় দীর্ঘ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না। ফলে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অজ্ঞাত লাশের ক্ষেত্রে কেউ দায়িত্ব নেয় না। মর্গে পড়ে থাকে দিনের পর দিন।
আরও এক কর্মকর্তা বলেন, অচেনা লাশ মানে ঝামেলা। কাগজপত্র, অনুমতি, টাকা সবই সময়সাপেক্ষ। তাই কেউ আগ্রহ দেখায় না। অথচ এই মানুষগুলোও এক দিন ছিল কারও প্রিয়জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে। এটা মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্রও তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ।