মৌসুমের শুরুতেই চোখরাঙাতে শুরু করেছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। হাসপাতালে বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা। ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটি কাটাতে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের টানে ছুটে গেছে মানুষ। অনেকেই বেলকুনি, ছাদবাগানের গাছ বাঁচাতে অতিরিক্ত পানি দিয়ে গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় পানি জমে থাকার জায়গা আরও বেড়েছে। জমে থাকা এই স্বচ্ছ পানি, অব্যবহৃত কমোডের পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তারের ঝুঁকিতে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের আশঙ্কা।
এ বছর ৫ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে বাসাবাড়ি, ভবনের ছাদ ও আশপাশের এলাকা দীর্ঘ সময় পরিচ্ছন্ন না থাকলে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যেতে পারে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী মূলত এডিস এজিপ্ট এবং এডিস এলবোপিক্টাস প্রজাতির মশা। এগুলো সাধারণত দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যায় মানুষকে কামড়ায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাতের বেলায়ও কামড়ায়। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার ও জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে। যেমন, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, ফ্রিজের ট্রে, এসির পানি জমানো স্থানে এডিস মশা ডিম পাড়ে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ছোট শহরে অধিক জনসংখ্যার কারণে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাত্র তৈরি হয়, যার মধ্যে পানি জমা হয়ে মশার বংশ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করছে। প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের প্লাস্টিকের পাত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, ব্যাগ। এগুলোতে পানি জমে ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে। এসব পাত্রে বৃষ্টি হলেই কমবেশি পানি জমে এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত জায়গা তৈরি হয়। বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে প্রায় সব জায়গায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অভাবে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে, যা মশার বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি করে। শহরের উঁচু ভবন ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আলো-বাতাস চলাচল কম হওয়ায় মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ২০০০ সালে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয় এবং মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। বর্তমানে ডেঙ্গু শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং ৫৭৫ জন মারা গেছেন। ঈদ-পরবর্তী সতর্ক না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু দেশের জন্য একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জনসচেতনতার অভাবের ফলে এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। আগাম ব্যবস্থা না নিলে এ বছরও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উষ্ণ আবহাওয়ায় মশার ডিম থেকে পূর্ণবয়স্ক মশা হয়ে উঠতে কম সময় লাগে। ফলে মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিয়মিত ও অতিবর্ষণের ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে, যা মশা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। জেলা শহরগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষিত জনবল ও বাজেট না থাকায় নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য। প্রতিটি জেলা শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করা দরকার।