আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) অপপ্রচার ও গুজব মোকাবেলাকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। ইসি তা মোকাবেলা করতে পারবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। এ সময় নির্বাচন কমিশন জনগণের কতটুকু আস্থা অর্জন করবে তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
সোমবার (৬ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসি আয়োজিত সংলাপে এসব আশঙ্কা প্রকাশ করেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। এদিন দুই দফায় ৪৪ জন গণমাধ্যম প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নেন। সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিষয়ে ইসির অবস্থান জাতির কাছে পরিষ্কার করার দাবি জানান কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ।
তিনি বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য আমরা জানতে চাই। এই বক্তব্য সুস্পষ্ট না হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। আওয়ামী লীগের ভোটারদের তো আপনি (নির্বাচন কমিশন) বাদ দিতে পারবেন না। তারা তো দেশের নাগরিক। যদিও তারা অনুশোচনা করেনি, এখন পর্যন্ত প্রায়শ্চিত্ত করেনি, অনুতপ্ত হয়নি। তার পরও তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচনটা হতে পারে না।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট অবস্থান জাতির কাছে পরিষ্কার করবেন, আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে পরিষ্কার করবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাইব, আপনারা দৃঢ়তার পরিচয় দেবেন। দেশপ্রেমের পরিচয় দেবেন, অঙ্গীকার রক্ষার পরিচয় দেবেন। অতীতে নির্বাচনগুলো যাঁরা পরিচালনা করেছেন, তাঁরা এখন কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন। আপনাদের সামনেও কিন্তু সেই আশঙ্কাটা আছে। তিনি বলেন, আপনারা আছেন পুলসিরাতের মধ্যে।’ প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সামাজিক কমিটি করার প্রস্তাব করেন তিনি।
দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের বলেন, নির্বাচনের মৌসুমে কিছু কিছু গল্পকার দেখা যায় বিভিন্ন জেলায়। এই গল্পকাররা আমাদের শোনান আড়াই হাজার ভোট ৩৫ মিনিটে কাস্ট হয়ে গেছে। অথবা সারা দিন শুনলাম ৭ ভোটে আবু তাহের পিছিয়ে আছেন। অথচ সন্ধ্যায় ঘোষণা করা হলো, তিন হাজার ভোটে আবু তাহের জয়লাভ করেছেন। এই রূপকথাগুলো কারা শোনান? দুই ধরনের ভদ্র সন্তান এই গল্প শোনান। একজন হলেন ওসি, আরেকজন হলেন ডিসি। এ দুই ধরনের ভদ্র সন্তান নিয়ে যেন ইসি সজাগ থাকেন।
বাংলানিউজ ২৪ ডট কমের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, আমরা যে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করছি, নির্বাচন হবে কি হবে না, সেটা আসলে রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নির্বাচন কিভাবে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাই ইসির ক্ষমতাকে নির্ধারণ করে। গত তিন টার্মে সেটাই হয়েছে। যে কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বা করা যায়নি।
নিউজ২৪-এর হেড অব নিউজ শরিফুল ইসলাম খান বলেন, ইসিকে আইনের মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, অনেক কথা শোনা যাচ্ছে, নানা রকমের শঙ্কা, আশঙ্কা, কী হবে কী হবে না- এগুলো নিয়ে অনেক রকম কথা আছে, গুজব আছে, অপতথ্য আছে। তবে আমাদের সরকারপ্রধান বলেছেন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন হবে এবং ভালো নির্বাচন হবে।
দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব নিউজ জিয়াউল হক বলেন, ভোটকেন্দ্রে ঢুকে সাংবাদিকরা যেন কোনো বাধা ও হয়রানির শিকার না হন এবং তাঁদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়- আমি কমিশনের কাছে এই দাবি জানাই।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, আমার সুপারিশ হলো, প্রার্থীর হলফনামা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন এটা ওয়েব সাইটে আপলোড করা হয়। এতে তাঁর ভোটার এবং পুরো দেশের মানুষ ওই প্রার্থী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানতে পারে। একাত্তর টিভির বার্তাপ্রধান শফিক আহমেদ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে হবে।
যমুনা টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমের অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক (সিএনই) মোস্তফা আকমল বলেন, বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপ্রপ্রচার। যেকোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে যদি কোনো নারী কেলেঙ্কারি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু তিনি ড্যামেজ্ড হয়ে যাবেন। এআই দিয়ে এক-দুই মিনিটের মধ্যে একটা ভুয়া ছবি তৈরি করে ফেলা যায়। এটা ইসিকে মোকাবেলা করতে হবে।
সংলাপে নির্বাচন কমিশনারদের বক্তব্যের সময় মিস-ইনফরমেশন, ডিস-ইনফরমেশন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) অপপ্রয়োগ এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা বলে মন্তব্য করেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, মিস-ইনফরমেশন যত ছড়াচ্ছে, মানুষের মধ্যেও ততটা সন্দেহবোধ তৈরি হচ্ছে। মানুষ এখন চেক করে দেখে তথ্য ঠিক কি না।
তিনি আরও বলেন, বিটিআরসি, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিএনসিসির সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বাস্তবতা হচ্ছে, মেটা (ফেসবুক) তাদের থ্রেশহোল্ড এত নিচে নামিয়েছে যে অনেক কনটেন্টই এখন সহজে পার হয়ে যাচ্ছে। আমরা যেগুলোকে থ্রেট ভাবছি, তার অনেকগুলোই দৃশ্যমান থাকবে। তা ছাড়া ৫০ শতাংশেরও বেশি সোর্স ট্রেস করা যায় না; তারা দেশের সীমানার বাইরে। ফলে তাদের কোনো বাধ্যবাধকতায় আনা যায় না।
‘স্বচ্ছভাবে আয়নার মতো পরিষ্কার করে নির্বাচনটা করতে চাই’-মন্তব্য করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের লুকানোর কিছু নেই। দেশ ও বিশ্বকে দেখাতে চাই স্বচ্ছ নির্বাচন। স্বচ্ছভাবে আয়নার মতো পরিষ্কার করে নির্বাচনটা করতে চাই। আমাদের সাফ কথা, গণমাধ্যমের সহযোগিতা লাগবে। স্বচ্ছ পদ্ধতিতে কাজটা সারতে চাই।
সংলাপকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনসহ চার নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন বৈশাখী টিভির বার্তাপ্রধান জিয়াউল কবীর সুমন, গ্লোবাল টিভির চিফ নিউজ এডিটর ফেরদৌস মামুন, চ্যানেল আইয়ের জাহিদ নেওয়াজ খান, ডিবিসির সম্পাদক লোটন একরাম, এটিএন নিউজের শহীদুল আজম, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আব্দুল হাই শিকদার, দ্য ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শহীদুল আহসান ও ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুণ জামিল।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ