ভূমিসেবা দুর্নীতিমুক্ত রাখতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন উদ্যোগের পরও এই সেবা খাতে দুর্নীতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূল থেকে ওপরের দিকে বিভিন্ন ভূমি অফিস যেন ঘুষের হাট। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি বলছে, সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় বিচারিক সেবায়।
এর পরই আছে ভূমি, ব্যাংকিং, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছিল। টিআইবি বলছে, ২০২৩ সালে ঘুষের শিকার হয়েছে দেশের প্রায় ৫১ শতাংশ পরিবার (খানা)। সেবা নিতে গিয়ে ২০২৩ সালে খানা প্রতি ভূমি সেবায় ১১ হাজার ৭৭৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
অবস্থা এখন কেমন, তা দেখতে গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে ভূমি অফিস ঘুরে দেখলে সেবাগ্রহীতাদের নানা হয়রানির চিত্র উঠে আসে। জানা যায়, পেশকার থেকে শুরু করে অফিস সহকারীরাও ঘুষ ছাড়া আবেদনই গ্রহণ করেন না। ঘুষ না দিলে আবেদনকারীকে ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।
বরিশালে ঘুষের টাকা নেন রফিক লাল : ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ চর আইচা মৌজায় ৭০ শতাংশ জমির মালিক ফিরোজা বেগম ও ছখিনা বেগম। বিএস জরিপে জমি তাঁদের নামে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ৩০ ধারা করার সময় তাঁরা এলাকায়ও ছিলেন না। বরিশাল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে যোগাযোগ করলে ৩০ ধারার আপত্তি গ্রহণ করা হয়নি।
গত ১১ নভেম্বর তারা ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ৩০ ধারার আপত্তি নেওয়ার আবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত অধিদপ্তর থেকে বরিশাল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারকে তা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফিরোজা ও ছখিনার ভাই নীরব বাঘা বরিশাল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের পেশকার রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক লালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আগেই তথ্য নিয়ে রফিকের সঙ্গে দেনদরবার করেন। ৩০ ধারার আপত্তি গ্রহণ নিশ্চিত করতে রফিককে ৮০ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন নীরব। নীরব সেই অর্থও দেন রফিককে। তবে গত ১৬ এপ্রিল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার চিঠিতে জানা ৩০ ধারার আপত্তি গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার ফিরোজার ভাই নীরব জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে গিয়ে সেই চিঠি হাতে নিয়ে কক্ষে বসেই রফিক লালের ওপর চড়াও হন। নীরব বলেন, রফিক আমার কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছিল, পরে আশি হাজার টাকা দিই। আজ (গতকাল) অফিসে এসে দেখি, আমার ৩০ ধারার আপত্তি খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার দক্ষিণ ছোট মানিকা মৌজার ১৫ শতাংশ জমি বিএস জরিপে অন্যের নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই জমি সংশোধনে ৪২(ক) ধারায় আপত্তি করেন মালিক আছমত আলী ফরাজী। আপত্তির আবেদন নেওয়ার জন্য পেশকার রফিক ১৫ হাজার টাকা নেন। আছমত এ ধরনের আরো তিনটি আবেদন করেছিলেন। প্রতিটি আবেদন গ্রহণের জন্য রফিককে ১৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। এতে লাভ হয়নি আছমতের। প্রতিটি আপত্তির আবেদন বাতিল করা হয়েছে। আছমত বলেন, অন্য পক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আমার আপত্তিগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বরিশাল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে গেলে পেশকার রফিকের বিরুদ্ধে এমন বহু অভিযোগ শোনা যায়। রফিককে ১৫ থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। তাঁর সহযোগী অফিস সহকারী আবুল কালাম ও আব্দুর রশিদ। দুপুর দেড়টায় জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার বিনোদ বিহারি ত্রিপুরার কক্ষে অফিস সহায়ক আবুল কালামকে দেখা যায়। আবুল সেবা প্রহীতাদের কাছ থেকে ৪২(ক) ধারার আবেদন ও সেই সঙ্গে টাকা নিচ্ছিল। তখন ছবি তোলা হলে বিনোদ ও আবুল কালাম ক্ষিপ্ত হন। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। আবুল বলেন, আবেদন লিখে, কাগজপত্র গুছিয়েই এ টাকা নিই। লোকে খুশি হয়ে দেয়। রফিক লাল বলেন, যাঁরা আবেদন লিখে দেন তাঁরা কিছু টাকা নিতে পারেন। বরিশাল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার মৃধা মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, পেশকার রফিকের বিরুদ্ধে আমার কাছে কয়েকটি অভিযোগ এসেছে। কেউ লিখিত অভিযোগ না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে মহাপরিচালকের দপ্তরে জানাব।
ভোলায় ঘুষ না দিলে নামজারি হয় না : গতকাল ভোলা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে গেলে হয়রানির আরেক চিত্র পাওয়া যায়। নামজারি ও মিসকেসসহ বিভিন্ন কাজে পদে পদে হয়ারানির অভিযোগ এনে সেখানে উপস্থিত ভুক্তভোগীরা জানান, টাকা দিলেই সেবা মিলছে। না হলে কৌশলে ঘুরানো হচ্ছে। জমির নামজারির আবেদনকারীদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি তাঁর মা-বাবাসহ নিজেদের নামের দুই একর জমির নামজারির জন্য গত ২৮ অক্টোবর আবেদন করেছেন। শুনানির দিন ধার্য করা হয় ৪ নভেম্বর। সব কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও গত ৯ নভেম্বর এসি ল্যান্ড আহসান হাফিজ নামজারির আবেদন খারিজ করে দেন। এক কর্মচারী এসি ল্যান্ডের নাম বলে নামজারির জন্য তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ চেয়েছিল। সামর্থ্য না থাকায় ওই টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে অফিসে এলেও ঘুরতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তি এসি ল্যান্ডের কাছে গেলে তিনি তাঁকে ধমকের স্বরে বলেন, আপনি আমার স্টাফের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন। ভোলা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আহসান হাফিজ বলেন, নামজারির জন্য আমার নাম করে কেউ টাকা দাবি করলে সরাসরি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। সব ধরনের আবেদন প্রক্রিয়ার পর গ্রহণ করা হবে। গতকাল সহকারী কমিশনারের কক্ষের সামনে ৯ জন সেবাপ্রার্থী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা জানান, সকাল ৯টা থেকেই অপেক্ষায় আছেন। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সহকারী কমিশনার অফিসে আসেননি। পরে এলেও তাঁর দেখা মেলেনি। দুপুর ২টায় তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন। সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর জানান, তাঁদের পারিবারিক ৬ একর জমি বিএস রেকর্ডে খাস খতিয়ানে চলে যাওয়ায় ওই জমি ফিরে পেতে গত ৫ মার্চ উপজেলা ভূমি অফিসে মিসকেস করেছেন। তিন বারে এসেও সমাধান পাননি। তাই এসি ল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলতে এসে তাঁকে পাননি।
ময়মনসিংহে সার্ভেয়ার নেই : গতকাল দুপুর পৌনে ৩টায় ময়মনসিংহ সদর উপজেলা ভূমি অফিসে গেলে আব্দুল কাদির ফকির (৩০) জানান, তাঁর বাড়ি চরাঞ্চলে। ১১ শতাংশ পৈতৃক সম্পত্তির খাজনা তিনি দিতে পারছেন না। জটিলতা নিরসনে এক মাস ধরে ইউনিয়ন ভূমি ও এসি ল্যান্ড অফিসে দৌড়াদৌড়ি করছেন। এক মাসে এসি ল্যান্ড অফিসেই এসেছেন পাঁচবার। এ অফিস থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সেখান থেকে আবার সার্ভেয়ারের মতামতের জন্য বলা হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত এসি ল্যান্ড অফিসে অবস্থান করেও সার্ভেয়ারের দেখা পাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সার্ভেয়ার পদটি শূন্য রয়েছে। অফিস সহকারী মোশাররফ হোসেন বলেন, নতুন সার্ভেয়ার যোগ দেননি। ভুক্তভোগী সারওয়ার হোসেনের বাড়ি নগরীর কাঠগলা ঢোলাদিয়ায়। তাঁর জমি ২০ শতাংশ। ২০১৮ সালে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল থেকে জমির বিষয়ে রায় পান। তাঁর কাগজপত্রও এসি ল্যান্ড অফিসে হারিয়ে গিয়েছিল। খাগডহর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার অফিস তাঁকে বেশি হয়রানি করেছে উল্লেখ করে বলেন, এসি ল্যান্ড অফিসের নাজির আল ইমরান শাহীনের সঙ্গে কথা বলার জন্য এসে তাঁকেও পাচ্ছি না। সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাঈদ মোহাম্মদ ইব্রাহীম অবশ্য বলেন, সমস্যাগ্রস্ত কেউ তাঁর কাছে এলে তিনি সমাধানের চেষ্টা করেন।
কক্সবাজারে ঘুষে চলে ফাইল : কক্সবাজার জেলা সদরের এসি ল্যান্ড অফিসের যাবতীয় কাজ নাজির আলমগীরের হাত দিয়েই হতে হয়। অর্ধ লাখ থেকে লাখ টাকার কমে কোনো কাজ আলমগীরের কাছে আশা করা যায় না। কক্সবাজার পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম এসএম পাড়ার বাসিন্দা ইবনে হাসান রিফাত গতকাল জানান, তাঁর মা রেহেনা বেগমের আবেদন করা খুরুশকুল মৌজার ১৯৭০/২৪ ক্রমিকের নামজারি আবেদনে নাজির আলমগীর তাঁর কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি এরপর জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগ করায় এখন কাজই হচ্ছে না। নাজির আলমগীর বিষয়টি সত্য নয় দাবি করে বলেন, খতিয়ান সৃজনের আবেদনটি শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। সদরের ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার সৈয়দ নূরের বিরুদ্ধে অবৈধ দাবিদাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঝিলংজা মৌজার বিএস-২০৫৫ নম্বরের খতিয়ানের পৈতৃক জমির মালিক দিনমজুর পূর্ণচন্দ্র দে খাজনা দিতে গেলে তহশিলদার অতিরিক্ত টাকা চান। ঘুষ দিতে না পারায় খাজনাও দেওয়া হয়নি পূর্ণচন্দ্রের।
সূত্র: কালের কণ্ঠ