পৃথিবীতে এমন কিছু প্রজাতির সাপ আছে যেগুলোর মানুষ খাওয়ার ক্ষমতা আছে। যদিও এসব সাপের কোনওটিতেই বিষ নেই, তবুও এদের সকলের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই বিশাল আকারের।
এগুলো নিজের আকৃতির চেয়ে কয়েক গুণ বড় শিকারকেও আস্ত গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে এরা। শিকারের উপায়ও অভিনব। প্রথমে ধারালো দাঁত দিয়ে শিকারকে কব্জা করে ফেলা। তারপর নিজের শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ধরা।
শিকারকে এরা ততক্ষণ চেপে ধরে থাকে, যতক্ষণ না শিকারের শ্বাস বন্ধ হচ্ছে। দেহের চাপে মটমট করে ভাঙতে থাকে শিকারের হাড়। নিজের দেহ সঙ্কুচিত করে তাকে ক্রমশ পিষে ফেলে। শিকার হয়ে যায় নিস্তেজ। তারপর ধীরে ধীরে শিকারকে উদরস্থ করতে থাকে এরা।
সাধারণত বন্য শিকারকেই খাদ্য হিসেবে বেছে নেয় এই প্রজাতির সাপগুলো। তবে কখনও লোকালয়ে ঢুকে পড়লে বাদ যায় না মানুষও। অসতর্ক মুহূর্তে অতর্কিতে আক্রমণ করে মানুষের দেহকে পেঁচিয়ে গলাঃধকরণ করে এরা। ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গলের ধারে যেসব বসতি রয়েছে, সেখানে প্রায়শই শোনা যায় প্রকাণ্ড সাপের খাদ্যে পরিণত হয়েছে মানুষ।
অজগর এবং অ্যানাকোন্ডার মতো সবচেয়ে বড় সাপও মূলত ইঁদুর, পাখি এবং অন্যান্য ছোট থেকে মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের খায়। কিছু পরিস্থিতিতে তারা মানুষকে শিকার করে। এমন আচরণ ঘটে যখন সাপটি কোনও ব্যক্তিকে তার স্বাভাবিক শিকার বলে ভুল করে বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়ে অথবা খাবারের অভাব ঘটে।
পৃথিবীতে মোট পাঁচ ধরনের পাইথন বা অজগরের কথা জানা যায়- যারা হরিণ, ছাগল, শুকর, কুমির, বাছুর ছাড়া কালেভদ্রে মানুষও শিকার করে বা করার ক্ষমতা রাখে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক মানুষখেকো এসব সাপের তালিকা-
রেটিকুলেটেড পাইথন
প্রথমেই এই তালিকার উপরে রাখতে হবে রেটিকুলেটেড পাইথনকে। এটি বিশ্বের অন্যতম লম্বা সাপ এবং অন্যতম লম্বা সরীসৃপও বটে। ৩০ ফুটের কাছাকাছি দৈর্ঘ্য এটির। এর দেহ বিভিন্ন রঙের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল জ্যামিতিক নকশা করা। এই সাপ দুর্দান্ত সাঁতারুও বটে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দা এই সাপটিকে সাধারণত বৃষ্টিঅরণ্য, বনভূমি এবং তৃণভূমিতে এবং প্রায়শই পানির উৎসের কাছাকাছি দেখা যায়। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, বোর্নিও, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়ার কিছু অংশে দেখা মেলে এই সাপের।
২০২৪ সালের জুনে ইন্দোনেশিয়ায় মানুষখেকো সাপের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং পরিচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি ঘটেছিল। একজন নারীকে ১৬ ফুট লম্বা একটি এই প্রজাতির অজগরের পেটে পাওয়া গিয়েছিল। ওই নারী নিখোঁজ হওয়ার পর সেখানে একটি অজগরকে পেট ফোলা অবস্থায় দেখতে পান স্থানীয়রা। সন্দেহ হওয়ায় সাপটি কেটে ফেলার পর নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
নমনীয় চোয়াল এবং পেট ও অন্ত্র প্রসারিত করার ক্ষমতা অজগরের এই প্রজাতিকে বড় প্রাণী, এমনকি মানুষকে গিলে ফেলতেও সাহায্য করে। এই মাংসাশী প্রজাতিটি সাধারণত ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি খায়। তাদের এমন শিকারের প্রতি প্রবল আগ্রহ রয়েছে, যা তারা পুরো গিলে ফেলতে পারে। তাই তারা সাধারণত বড় প্রাণী এড়িয়ে চলে। এরা ডিম এবং মৃতদেহও খায়।
আফ্রিকান রক পাইথন
আফ্রিকান রক পাইথন বিশ্বের বৃহত্তম সাপের প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি। তবে এটি রেটিকুলেটেড পাইথনের মতো লম্বা নয়। এই সাপ আফ্রিকার বেশির ভাগ অংশজুড়ে বাস করে। এগুলো বাসস্থানের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন উপ-প্রজাতিতে বিভক্ত। মধ্য আফ্রিকার রক পাইথন হল বৃহত্তম উপ-প্রজাতি।
২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে একটি ১০ বছর বয়সি ছেলেকে একটি আফ্রিকান রক পাইথন গিলে ফেলার পর সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে। এটি ছিল এই প্রজাতির মধ্যে প্রথম মানুষ খাওয়ার ঘটনা। সাপটি ছেলেটিকে পেঁচিয়ে মেরে তাকে সম্পূর্ণরূপে গিলে ফেলে।
আফ্রিকান রক পাইথন দৈর্ঘ্যে ২০ ফুটেরও বেশি হতে পারে। এর উপরের এবং নীচের চোয়ালগুলো প্রসারিত লিগামেন্ট দিয়ে সংযুক্ত। এর সাহায্যে এরা নিজের চেয়েও চওড়া প্রাণীদের গিলে ফেলতে পারে। এটি হরিণ এবং কুমিরের মতো প্রাণীদের শিকার করে বলে জানা গেছে গবষেণায়।
সবচেয়ে বড় সাপগুলোর ওজন প্রায় ২০০ পাউন্ড বা ৯০ কেজির আশপাশে হয়। এরা ছাগল এবং কিছু প্রজাতির হরিণের মতো বড় শিকার ধরতে সক্ষম। শিকারের ক্ষেত্রে তারা রেটিকুলেটেড পাইথনের মতো খুঁতখুঁতে নয়। এরা ইঁদুর, হরিণ, এমনকি কুমির এবং অন্যান্য সরীসৃপ খেতে পারে।
অ্যানাকোন্ডা
অ্যানাকোন্ডা! পানি-জঙ্গলের ত্রাস হিসেবে ‘খ্যাতি’রয়েছে অ্যানাকোন্ডার। আমাজনের এই দানবাকৃতির সাপটিকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্প। হলিউড থেকে শুরু করে নানা দেশে তাকে নিয়ে ছবি তৈরি হয়েছে। ঘন গভীর আমাজনের ‘মৃত্যুদূত’ হিসেবে পরিচিত অ্যানাকোন্ডা।
সবুজ অ্যানাকোন্ডা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত সাপ। এটি দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ পরিবেশের জলাভূমিতে বাস করে। সমস্ত অ্যানাকোন্ডা প্রজাতির মধ্যে সবুজ অ্যানাকোন্ডা সবচেয়ে বড়।
শিকারকে শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ভয়াবহ চাপ দিতে থাকে এরা। সেই চাপে শিকারের হাড়গোড় ভেঙে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। তারপর শিকারকে আস্ত গিলে খায় সাপটি। এদের শিকার ধরার কায়দাও রোমহর্ষক। এদের চলাফেরা প্রায় নিঃশব্দ। তড়িৎগতিতে পানি ভেঙে শিকারকে ঘায়েল করতে ওস্তাদ আমাজনের এই রাজা।
বিশাল ও ভারী চেহারা এবং আকারের জন্য মানুষের জন্য এরা বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে তারা মানুষকে গিলে খাওয়ার ক্ষমতা রাখে। অ্যানাকোন্ডার মানুষ খাওয়ার ঘটনা যদিও খুবই কম।
বার্মিজ পাইথন
অজগরের প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বার্মিজ পাইথন। বছরের পর বছর ধরে পোষা প্রাণী হিসেবে তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এই সাপের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে মিয়ানমারে এগুলোকে পাওয়া যায়। ৩৫ কেজির আস্ত হরিণকে এক গ্রাসে গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে এই প্রজাতিটি। শিকার গিলে ফেলার জন্য এরা নিজেদের মুখকে ২২-২৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত প্রসারিত করতে পারে।
গত কয়েক বছরে ফ্লরিডায় সবচেয়ে বেশি বার্মিজ পাইথনের দেখা মিলেছে। এই সাপগুলোকে পোষার জন্য নিয়ে যাওয়া হলেও পরে তা স্থানীয় জলাভূমিতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
বার্মিজ পাইথন খুব কমই মানুষকে আক্রমণ করে। সাপগুলো কোনও মানুষকে গিলে ফেলেছে এমন উদাহরণও পাওয়া যায়নি। তাদের আকারের সঙ্গে তুলনা করলে সেই আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
বিডি প্রতিদিন/একেএ