আগামী ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। যা এখন চূড়ান্ত। ক্ষণ গণনাও শুরু করেছে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এলডিসি তালিকা থেকে বেরোনোর পর রপ্তানি ও কূটনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, সেক্ষেত্রে প্রস্তুতিতে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনাতেও নেই সন্তোষজনক অগ্রগতি। চলতি মাস শেষে এ সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দেখতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর আগে গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি।
জানা যায়, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ মানে হলো একটি দেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং অবকাঠামোগতভাবে উন্নত হয়েছে এমন একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি দেশের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু এর কিছু বড় চ্যালেঞ্জও আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই উত্তরণের পর বাংলাদেশ অনেক ধরনের আন্তর্জাতিক সুবিধা হারাবে। যেমন- ইউরোপ, কানাডা ও জাপানের বাজারে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আইনে ছাড়, বাণিজ্য সহায়তা ও অনুদানমূলক ঋণ পাবে না। এসব সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার অর্থ হলো-রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি। অর্থাৎ এসব দেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির জন্য অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হবে। এতে করে রপ্তানি খাতের ওপর বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। অবশ্য তখন বাণিজ্য সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে এর প্রস্তুতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট এফটিএ করতে হবে। যেসব কাজ মূলত উত্তরণের আগেই সম্পন্ন করতে হবে। যা হবে মূলত উভয় দেশের অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। যেহেতু সময় পিছানোর আর কোনো সুযোগ নেই তাই প্রস্তুতি যাই থাকুক স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে বের করে দেবে জাতিসংঘ।
অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য বিদেশে থাকা বাংলাদেশি মিশনগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ্ইউনূস। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ঊল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও ্ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে তা হয়নি। তবে চায়না ও জাপানের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, আমরা একেক দেশের সঙ্গে ইন্ডিভিউজুয়ালি সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) খাত থেকে। যদি এই খাতে কোনো সমস্যা হয় বা প্রতিযোগিতা বাড়ে, তাহলে অর্থনীতি বড় ঝুঁকিতে পড়বে। অন্য খাতগুলো এখনো তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। এজন্য রপ্তানি খাতকে বহুমুখীকরণ করার ব্যাপারে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। অবশ্য অতীতের সরকারগুলো বছরের পর বছর এ ধরনের কথা বলে এলেও বাস্তবে এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো সুস্পষ্ট শুল্কনীতি ঘোষণা করতে পারেনি। অথচ পাকিস্তান ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা সব পণ্যের শুল্ক ৯-১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তুতিতে নেপালও বিষয়ভিক্তিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও (যেমন ভারত, চীন) এ ধরনের শুল্ক সুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্প মূল্যে ওষুধ পায়। ২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধশিল্পের এই সুবিধা থাকবে না।
আমাদের শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা কম, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজস্ব আদায় কম, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, বৈদেশিক ঋণের চাপ। এসব সমস্যা অনেক দিনের। যা বছরের পর বছর আরও ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাইনি। ফলে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে এসব চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এলডিসি থেকে উত্তরণ সংক্রান্ত বৈঠকে পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১. জাতীয় সিঙ্গেল উইন্ডো পুরোপুরি চালু করা, ২. জাতীয় শুল্কনীতি ২০২৩ বাস্তবায়ন, ৩. জাতীয় লজিস্টিকস নীতি ২০২৪ অনুযায়ী অবকাঠামো উন্নয়ন, ৪. সাভার ট্যানারি ভিলেজে ইটিপি স্থাপন ও চালু রাখা এবং ৫. গজারিয়ায় এপিআই পার্ক চালু করে ওষুধ খাত শক্তিশালী করা। এর কোনোটিতেই তেমন কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি গত তিন মাসে।