মাধ্যমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই চলছে সংকট, অস্থিরতা। পাবলিক পরীক্ষা বাতিল দাবিতে আন্দোলন, পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে আন্দোলন ছাড়াও সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের চাপ দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা, গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ ও শিক্ষার্থীদের টানাটানিও থেমে নেই। কথায় কথায় ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিবিরোধী আন্দোলনে নামছেন। সব মিলিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে অনেক বিদ্যাপীঠে। স্কুল-কলেজ ছাড়াও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা এখন আর পাঠে মনোযোগী নয়, তারা নিজেদের ক্ষমতা জাহিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কথায় কথায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি, ক্লাস বর্জন তাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পান থেকে চুন খসলেই ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের ফলে জাতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা পড়ালেখা থেকেও ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পড়াশোনাবিমুখ তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্দোলন সংগ্রামের অস্থিরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হচ্ছে সেশনজট। ছাত্র-ছাত্রীদের সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
ছয় দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে সারা দেশের পলিটেকনিকে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে একাডেমিক কার্যক্রম। সম্প্রতি তারা মহাসড়ক অবরোধ করে পুরো রাজধানীবাসীকে যানজটে নাকাল করেছেন। এরপরও থেমে থেমে চলেছে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি। এখনো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন ছেড়ে ক্লাসে ফেরেননি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার পর আবার বিদ্যালয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নরোত্তমপুর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মারধরের শিকার হয়েছেন। মারধরের ফলে শিক্ষক ইউনুস নবীর পরনের জামা-কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ২৪ অক্টোবর তাঁকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়। শুধু ইউনুস নবী নন, সারা দেশে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো সহস্রাধিক শিক্ষক এখনো বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৩ এপ্রিল বিকাল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। ১৮ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রতিবাদে কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে কুয়েট শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কুয়েট উপাচার্যের সঙ্গে উপ-উপাচার্যকেও সরিয়ে দেয় সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ না হওয়ায় এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। টানা প্রায় দুই মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীরা।
গত শনিবার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাসেম মিয়া ও সিএসই বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ নুরুল হুদার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে শনিবার রাতেই উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগীয় প্রধান ও সব অনুষদের ডিন পদত্যাগ করেছেন। বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়েও বিরাজ করছে অস্থিরতা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো গণ অভ্যুত্থানের পর অস্থিরতা তৈরি হয়। কিন্তু এ সময়ে যারা দায়িত্বে থাকেন তাদের এই অস্থিরতা সামাল দেওয়া দায়িত্ব। এটি হয়তো আমরা সামাল দিতে পারিনি। এর ফলে সবার মধ্যে আন্দোলনের একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এমনটি কাম্য ছিল না। তিনি বলেন, সচিবালয়ে ঢুকে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর চাপের মুখে সরকার পিছু হটে ১৪ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যতের কথা না ভেবে পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। এরপর ছাত্ররা এই বার্তা পেয়েছে যে, আন্দোলন করলেই তাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান অস্থিরতা যত দ্রুত সামাল দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।