একের পর এক ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যা, যৌতুকসহ পারিবারিক কলহের জেরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন নারীরা। বিকৃত লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যাশিশু, মধ্যবয়সি নারী এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারী কেউই। ছোটখাটো পারিবারিক ঝগড়ার কারণে স্বামীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। আবার কোথাও কোথাও চোর বা মানসিক সমস্যার অপবাদ দিয়ে নারীদের ওপর ভয়ংকর শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে নারী নির্যাতনে এখন এক ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তারা আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এ সংস্কারে নারীর প্রতি যে সহিংসতা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু অন্য সব সরকারের মতোই গতানুগতিক ধারায় সবকিছুতে গুরুত্ব দিলেও নারী নির্যাতন ইস্যুতে গুরুত্ব না দেওয়া হয় তাহলে এটি হবে নারীর প্রতি অবহেলার শামিল।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যে, গত মার্চ মাসে দেশে ১৯৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ মাসে ১২৫ কন্যাশিশুসহ মোট ১৬৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এদের মধ্যে ১৮ কন্যাসহ ৩৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। বছরের প্রথম তিন মাসে মোট ৮৩৬ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শুধু মার্চেই নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মোট ৩৯৪ আর মার্চে নির্যাতনের শিকার হন ৪৪২ নারী ও কন্যাশিশু। গেল তিন মাসে ধর্ষণের শিকার হয় ২৬০ জন।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে যে সরকারই থাকুক নারীর প্রতি যে সহিংসতা হচ্ছে তা ঠিকমতো নজরদারি করা হয় না। সব সরকারই নারী নির্যাতন দমানোর কথা বলে, এ সংক্রান্ত আইন করেন কিন্তু এই বিষয়টি ফলোআপের সময় তার বাস্তবায়ন আর করে না। মহিলা ও আইন বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে যারা আছেন এবং তাদের যে সভা হয় সেখানে তারা পারিবারিক সহিংসতাসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো কোথায় বেশি হচ্ছে এবং তা কেন ঘটছে তা দেখে এবং এগুলো নিরাময়ের জন্য ব্যবস্থা করে তাহলে নারী নির্যাতনের ঘটনা কমে আসবে। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ফলোআপ করা উচিত। প্রতি জেলার ইউএনও, ডিসি এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা তারা এগুলো নিয়ে কখনো ফলোআপে থাকেন না। প্রশাসনের সব পর্যায় থেকে এ বিষয়ে যদি জবাবদিহিতা থাকত তাহলে নারী নির্যাতনের এখন যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তা আর বাড়ত না।
বেশ কয়েকটি ঘটনায় সম্প্রতি নারী নির্যাতনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি উঠে এসেছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে নাগরদোলা চড়া অবস্থায় গলা কেটে হত্যা করে তার স্বামী। গত ১৪ এপ্রিল রাতে এ ঘটনা ঘটে। লাকি আক্তার নামের নারীর সঙ্গে গত বছর বিয়ে হয় সাকিব হোসেনের। লাকি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ১৫ দিন আগে লাকি তার স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি আসেন। সেখানে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় স্বামীসহ লাকি বৈশাখী মেলায় ঘুরতে যান। সেখানে নাগরদোলায় ওঠেন। নাগরদোলা চড়া অবস্থায় গলায় ছুরি চালিয়ে লাকিকে হত্যা করা হয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়ায় চুরির অপবাদে প্রকাশ্যে তিন নারীর চুল কেটে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সুমন দাসসহ কয়েক যুবকের বিরুদ্ধে। ১৩ এপ্রিল রাতে চুরির অপবাদ দিয়ে কয়েক যুবক তিন নারীকে মারধর করে। এ সময় কয়েকজন নারীর মাথার কাপড় খোলেন এবং তাদের চুল কাটেন। বরগুনার আমতলীতে বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে যাওয়ায় এক নারীকে মারধর করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল এই নারী তার প্রেমিক কালামের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের দাবিতে অনশনে বসেন। ঘটনার দিন সেই নারীকে কালামের মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা লোহার শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করেন। পটুয়াখালীর মহিপুরে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে (৩০) মারধরের অভিযোগ উঠেছে সেলিম খাঁ (৩৫) নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ওই নারীর শরীরের বিভিন্ন স্থানসহ ডান চোখ গুরুতর জখম হয়। এ ছাড়া রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার আপন কফি হাউসের সামনে এক তরুণীকে মারধরের ঘটনায় কফি হাউসের ম্যানেজার আলামিন ও ওয়েটার শুভ সূত্রধরকে আটক করা হয়েছে। তরুণীকে মারধরের ভিডিও গত ১৪ এপ্রিল ফেসবুকে ভাইরাল হলে পুলিশ তাদের আটক করে। ঘটনাটি গত ১১ এপ্রিলের। ভুক্তভোগী ওই তরুণীকে টেনেহিঁচড়ে গলায় ধাক্কা দিয়ে কফি হাউস থেকে বের করে পরে লাঠি দিয়ে পেটায় রেস্টুরেন্টটির এক কর্মচারী।