গত বছরের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রুভেন রিভলিন বলেছিলেন, প্রয়াত ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয় বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি ইসরায়েলি ‘হয় সন্ত্রাসী নয়তো সন্ত্রাসীর সন্তান’। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বাকিংহাম প্রাসাদে প্রবেশ করতে দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন রানি।
রিভলিন বলেন, আমাদের (ইসরায়েল) এবং রাণী এলিজাবেথের মধ্যে সম্পর্ক একটু কঠিন ছিল।
রিভলিন ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের ১০ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রানি এলিজাবেথ মারা যান ২০২২ সালে। রিভলিন বলেন, রানি বিশ্বাস করতেন যে আমাদের প্রত্যেকেই হয় সন্ত্রাসী নয়তো সন্ত্রাসীর সন্তান। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান ছাড়া তিনি (বাকিংহাম) প্রাসাদে কোনও ইসরায়েলি কর্মকর্তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
টানাপোড়েনের ইতিহাস
রানির প্রায়শই ইসরায়েলিদের সাথে টানাপোড়েনের সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হত। সিংহাসনে থাকার ৭০ বছর ধরে ১২০টিরও বেশি দেশ এবং প্রায় দশ লক্ষ মাইল ভ্রমণ করা সত্ত্বেও তিনি কখনই ইসরায়েল ভ্রমণে যাননি।
এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, প্রভাবশালী কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অফ ইসরায়েল গ্রুপ এর সম্মানসূচক সভাপতি স্টুয়ার্ট পোলাক দাবি করেছিলেন, রাজপরিবারকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ইসরায়েল ভ্রমণে নিষেধ করেছিল। অন্যরা বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
২০১২ সালে রানির ইসরায়েল সফরে ব্যর্থতার কথা লিখে দেশটির গণমাধ্যম হারেৎজের সাবেক প্রধান সম্পাদক ডেভিড ল্যান্ডাউ বলেছিলেন, এই অসাধারণ, নিবেদিতপ্রাণ ৮৬ বছর বয়সী সার্বভৌমত্ব কারও হাতের পুতুল নয়। যদি তিনি ইহুদি রাষ্ট্র পরিদর্শন করতে চান অথবা তার ঘনিষ্ঠ পরিবারের কেউ সেখানে যেতে চান, তাহলে তিনি জোর দিয়ে বলতে পারতেন এবং তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারতেন।
কেউ কেউ অনুমান করেছেন, ১৯৪০-এর দশকে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে জায়নিস্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে যে সহিংস বিদ্রোহ চালিয়েছিল, তার কারণে এলিজাবেথ ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন।
১৯৮৪ সালে জর্ডান সফরকালে তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরের আকাশে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘কত ভয়ঙ্কর’। জর্ডানের রাজা হোসেনের স্ত্রী রানি নুর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা ভয়ঙ্কর।’
পরবর্তীতে রানি এলিজাবেথকে পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের অবস্থান চিত্রিত একটি মানচিত্র দেখানো হয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন, কি হতাশাজনক মানচিত্র।
রাজা চার্লস এবং ইসরায়েল
২০১৮ সালে যখন রানির নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ইসরায়েলের স্বাধীনতার ৭০তম বার্ষিকীতে দেশটিতে গিয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত রাজপরিবারের কোনও সদস্যই সরকারিভাবে ইসরায়েল সফর করেননি। রিভলিন বলেন, এলিজাবেথের পুত্র রাজা চার্লস তার মায়ের তুলনায় সবসময় ‘অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ’ ছিলেন।
চার্লস ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ওয়েলসের যুবরাজ হিসেবে ইসরায়েল সফর করেন। তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরও পরিদর্শন করেন, যেখানে তিনি ‘ভবিষ্যৎ সকল ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং সমতা বয়ে আনুক’ বলে তার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেন।
রাজা পূর্বে ইসরায়েল সম্পর্কে তার মতামতের জন্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ২০১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের পর ১৯৮৬ সালে তার এক বন্ধুকে লেখা একটি চিঠি সামনে আসে। সেখানে তিনি কুরআনের কিছুটা অংশ পড়েছেন এবং ইসলামের কিছু দিকের প্রশংসা করেছেন বলে লিখে তৎকালীন রাজপুত্র বলেছিলেন, তিনি ইসরায়েল সম্পর্কে আরবদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে শুরু করেছেন। তিনি লিখেছিলেন, কখনও বুঝতে পারিনি যে তারা এটিকে একটি মার্কিন উপনিবেশ হিসেবে দেখে। আমি এখন উপলব্ধি করি যে আরব এবং ইহুদিরা সবাই মূলত সেমিটিক জাতি ছিল এবং বিদেশি, ইউরোপীয় ইহুদিদের (বিশেষ করে পোল্যান্ড থেকে, তারা বলে) আগমনই বড় সমস্যা তৈরিতে করেছে।
সবচেয়ে বিতর্কিতভাবে চার্লস জিজ্ঞাসা লিখেছিলেন, নিশ্চয়ই কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং লড়াই করার সাহস থাকতে হবে?
এই বছরের জুলাই মাসে, রাজা বলেছিলেন ব্রিটেন একটি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি কার্যকর এবং সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র এবং ইসরায়েল সম্পর্কিত বিতর্ক তরুণ রাজপরিবারের সদস্যদেরও স্পর্শ করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম যখন গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান, তখন ইসরায়েলি সরকার "হতাশ" হয়ে পড়েছিল বলে জানা গেছে, কিন্তু "ভবিষ্যতের রাজার সাথে বিরোধে জড়াতে না চাওয়ায় প্রকাশ্যে তার সমালোচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয়"।
সূত্র: মিডলইস্ট আই
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল