অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের যে সময়সীমার কথা বলা হয়েছে, সে ব্যাপারেও এখনো আশ্বস্ত নয়। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা বলছেন, ডিসেম্বর বা পরের বছরের জুনের মধ্যে দিনক্ষণের কথা বলা নির্বাচনের কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নয়। তারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার নানা শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আসলে কী ভাবছে কিংবা তাদের অবস্থান কী, সেটা স্পষ্টভাবে জানতে আগামী সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করবে দলটি। গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত কয়েক মাস ধরে বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের যে দাবি জানিয়ে আসছিল, সে ব্যাপারে একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশিকা পেতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থায়ী কমিটি। বর্তমানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। আগামী সপ্তাহে তাঁর দেশে ফেরার কথা। বিএনপি মহাসচিব দেশে ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নির্বাচনি রোডম্যাপ ইস্যুতে সাক্ষাৎ করবে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান ও সংশয়ের বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে জানাবে দলটি। একই সঙ্গে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির মতামতও তুলে ধরা হবে। এরপরই দলীয় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপির হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে তারা দুই-একটি কর্মসূচির দিকেও যেতে পারে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া দুজন সিনিয়র সদস্য বলেন, সরকারের উচিত নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্কারগুলো দ্রুত সম্পন্ন করা এবং চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করা। নির্বাচনকেন্দ্রিক যত সংস্কার রয়েছে, সেগুলো সরকার একটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে পারে। বাকি সংস্কারগুলো একটা রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ করবে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা আশা করছি, সরকার তার কথা রাখবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবে। ড. ইউনূসের মন পরিচ্ছন্ন। তিনি নির্বাচন দিতে চান। কিন্তু তার আশপাশে সুবিধাভোগী-উচ্ছিষ্টভোগী একদল লোক আছে, যারা আওয়ামী লীগের আমলেও সুবিধা ভোগ করেছে, এখনো ভোগ করছে, আগামী দিনেও ভোগ করবে। এরা প্রশাসন, সচিবালয়, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভিতরে-বাইরে সব জায়গাতেই আছে। এমনকি ড. ইউনূসের কিচেন ক্যাবিনেটেও আওয়ামী লীগের লোক রয়ে গেছে। তিনি যদি শক্ত না থাকেন তবে এসব সুবিধাভোগী তাঁকে সহজে ক্ষমতা ছাড়তে দেবে না।’
বৈঠকে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের বর্বরতা ও গণহত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপির নীতিনির্ধাকরা। তারা দ্রুত এ নৃশংসতা বন্ধের দাবিও জানিয়েছে। একই সঙ্গে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর এ বর্বর হামলা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে দুই-এক দিনে রাজধানীতে বড় ধরনের বিক্ষোভ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।
ওই সূত্র আরও জানায়, আগামী ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখে দেশীয় সংস্কৃতি ফুটিয়ে তুলতে দলীয়ভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নেবে বিএনপি। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে এবার পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের চিন্তা করছে হাইকমান্ড। সেদিন র্যালি থেকে শুরু করে মেলাসহ সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলায়ও দলীয়ভাবে এ কর্মসূচি পালিত হবে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেশ কয়েকটি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ও সংস্কারের ইস্যু ছিল অন্যতম। বিএনপি গত ২৩ মার্চ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার ওপর দলীয় মতামত জমা দিয়েছে। সেখানে সংস্কারের পক্ষেই দলটির মতামত রয়েছে। সংস্কার ইস্যুতে তারা যে সরকারকে সহযোগিতা করছে, সে বিষয়ে দলটি তাদের অবস্থান বারবার ব্যক্ত করছে। বৈঠকে একাধিক সদস্য বলেন, বিএনপি যেহেতু এ সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে এবং আগামীতেও করবে; সে কারণে নির্বাচনি রোডম্যাপ ইস্যুতে তারা বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে যেতে চান না।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর এটি ছিল দলটির নীতিনির্ধারকদের প্রথম বৈঠক। গত সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ভার্চুয়ালি শুরু হয়ে চলে প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ভার্চুয়ালি), স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান (ভার্চুয়ালি), নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (ভার্চুয়ালি), বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীরবিক্রম) ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন (ভার্চুয়ালি)।