জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সোমবার জুলাই গণ অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ৫০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায় তারা। ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন : আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করা, র্যাবের বিলুপ্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে আটকের ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ ও সমালোচকদের দমনের জন্য ব্যবহৃত আইন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে প্রতিবেদনে সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক যে সহিংসতা তৈরি হয়েছিল, গত বছরের আগস্টে গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর তাতে একটি স্থায়ী সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিবেদনে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি ঐকমত্য প্রস্তাব আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। যাতে সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন নিশ্চিত করা যায়।
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের আমলে বাকস্বাধীনতাকে দমন করতে নিবর্তনমূলক আইনটি করা হলেও, অন্তর্বর্তী সরকার ওই আইনের পরিবর্তে একটি নতুন অধ্যাদেশ চালু করেছে।
দুর্ভাগ্যবশত নতুন অধ্যাদেশে আগের আইনের মতোই অনেকগুলো ক্ষতিকারক ধারা-উপধারা রাখা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নভেম্বর পর্যন্ত সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার অভিযোগে কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। এ ছাড়া, সরকারি দপ্তরগুলোতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ১৫০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য পুলিশ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গণগ্রেপ্তার ও অজ্ঞাতনামা মামলা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। আটক ব্যক্তিকে যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারকের সামনে হাজির করা যায়। আটকে রাখার স্থান যাতে পরিদর্শন করা যায়। সেই সঙ্গে রিমান্ডের প্রচলনে নিষেধাজ্ঞা আনতে হবে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সাংবাদিককে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী রিমান্ডে নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতন করে থাকে।
এ ছাড়া যেসব আইন জবাবদিহির পথে বাধা, সেসব আইনকে সংশোধন বা বাতিল করার পরামর্শ অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে এইচআরডব্লিউ। এতে বলা হয়েছে, এই শর্তেই বিলুপ্ত করা হবে যে, র্যাবের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা অন্য বাহিনীতে গিয়ে একই ধরনের অপকর্মের চর্চা করতে পারবে না। একই সঙ্গে এই বার্তাও দিতে হবে যে, বাহিনীটিকে ভবিষ্যতে অপব্যবহার করা হবে না এবং পরবর্তী সরকারের দমন-পীড়ন চালানোর হাতিয়ার হবে না বাহিনীটি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, ‘প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, শুরু হয়েছে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের। বাংলাদেশে একটি অধিকার ও সম্মানজনক ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতের সরকারের যে কোনো দমন-পীড়নকে প্রতিহত করতে দ্রুত ও কাঠামাগত সংস্কার করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টে অর্জিত অগ্রগতি সফল হবে না।’