দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতি, রাজস্ব আদায়ে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি, ডলার বাজারে অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি আরও বেশি নাস্তানাবুদ করছে। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তির শর্ত পূরণ করতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা সরকারের। মূল্যস্ফীতির চড়া পরিস্থিতিতেও গতকাল সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়িয়েছে; যা মূল্যস্ফীতির চাপ আরও উসকে দেবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয়, শীতের ভরা মৌসুমে সবজির দাম কিছুটা নিম্নমুখী হওয়ায় সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে ক্রেতাদের। তবে বাজারব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় চালের দাম বাড়ছে অসময়ে। এ ছাড়া দুধ, ডিম, মাছ-মাংসের বাজারেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। অন্যদিকে, ডলারের বাজারে নতুন সংকট শুরু হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশেধের বোঝাও বেড়েছে; যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। এদিকে, আইএমএফের শর্তপূরণের জন্য আয় বাড়াতে ৬৭ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিলেও তা থেকে সরে এসেছে ভোক্তাদের বিরোধিতায়। আবার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষক ও খাতসংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বিপুল বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ পড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে নানা সংস্কার শুরু করলেও তা কাজে আসছে না। এ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ব্যবসাবাণিজ্যের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেনি পাঁচ মাসেও। এখনো ব্যবসায়ীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সরকারি সংস্থাগুলোতে সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়াতেও তেমন পরিবর্তন হয়নি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্পকারখানা। শিল্প বাঁচাতে বড় বড় শিল্প গ্রুপের মালিক ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আছেন। ব্যাংকিং খাতে ছোট-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা এখনো উপেক্ষিত। ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে সরব থাকলেও এখন নীরব। দেশে এখনো ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসেনি। অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বেসরকারি খাত সচল না হওয়ায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও স্বাভাবিক গতি ফেরেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকার সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসতে আরও সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতি স্বাভাবিক করতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না বলে তিনি মনে করেন। এদিকে, শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকারের রেখে যাওয়া বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমে গতি পাচ্ছে না। যদিও ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংকট নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে গত সরকারের সময়ে আর্থিক খাতে কী পরিমাণ লুটপাট এবং কত পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সে চিত্র তুলে আনাসহ সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর একটি শ্বেতপত্র তৈরি করে। কিন্তু সেই শ্বেতপত্রে দেওয়া পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে নতুন করে ২ হাজার কোটির বেশি টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনুসর দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিবার বলেছিলেন, ‘আমরা নতুন করে টাকা ছাপাচ্ছি না।’ কিন্তু কথা রাখতে পারেননি গভর্নর। এখনো মূল্যস্ফীতির চাপ প্রায় ২ অঙ্কের ঘরেই রয়েছে। মূল্যস্ফীতির এ চাপ সহসাই সহনীয় পর্যায়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাজারে আগের সিন্ডিকেট এখনও বিরাজমান। এজন্য আমদানি পর্যায়ে শুল্ক প্রত্যাহার করেও পণ্যমূল্য কমেনি। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজিও বন্ধ করা যায়নি।