‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’-পুরোনো প্রবাদ। তবে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং সদা বিদ্যমান। সমকাল থেকে ভাবীকাল- সর্বত্র এর সুরও ধ্বনিত। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোন বাণিজ্য? সাম্প্রতিক সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর- নীতি-আদর্শহীন রাজনীতির অবাধ বাণিজ্য এবং সে রাজনীতি হতে হবে জাগতিক লোভ, ব্যক্তিস্বার্থের উন্নতি এবং অবশ্যই মিথ্যাশ্রয়ী। তাহলে বাণিজ্য শুধু বাড়তেই থাকবে। আর এর সঙ্গে সহজ ধর্মীয় প্রভাব যুক্ত হলে পুঁজির সংকট একদমই থাকবে না! তবে সৎ নৈতিক অবস্থানে দৃঢ় আদর্শ হলে বাণিজ্যের চিন্তা-ভাবনায় কেউই আচ্ছন্ন হবে না। তবে এদের সংখ্যা বেশি নয়। ধারণা করা সংগত যে, আমাদের বিদ্যমান রাজনীতির অন্য নাম বাণিজ্য। বাণিজ্যের অন্য নাম রাজনীতি। তাই এতে ঝুঁকি আছে জেনেও রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ দুর্বলতা এবং মোহ সর্বাত্মক। এর মূল কারণও ওই সীমাহীন বাণিজ্য। তবে যেনতেন বাণিজ্য নয়, একদম পিলে চমকানো বাণিজ্য! শতকোটি থেকে হাজার কোটি তো কোন ছার! সবই এ বাণিজ্যের গুনেই তো? তাই ঝুঁঁকি তো নেওয়াই যায়! যদি লাইগা যায়! রাজনীতি বলতে সর্বাগ্রে ভাবতে হবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যাবে কত? ব্যবসার অন্য নামই বুঝি লাভ ও লোভের বাণিজ্য? তবে নির্লোভ নিরহংকারী উদার মানবতাবাদী রাজনীতিকও অবশ্যই আছেন। তারা প্রচারবিমুখ। সংখ্যায় হাতেগোনা। বাণিজ্য নিয়ে তাই আলোচনাও এখন সর্বত্র। তবে অবশ্যই এ রাজনীতি নীতিহীন। নীতি-নৈতিকতার রাজনীতি এখন যে নানাভাবে নির্বাসিত, তা বলাই বাহুল্য। নীতির রাজনীতি যেন এক ভ্রান্তির মোহ। বিশেষত দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের দেশে, আদর্শ সৎ পরিচ্ছন্ন রাজনীতির চর্চা এখন কদাচিৎই দেখা যায়! যাঁরা সে চর্চা করেন, তারা অসহায় এবং সংখ্যালঘু। তাদের মধ্যে দেশ ও মানবপ্রেম আছে বলেই অন্যায় অপকর্মে সমর্থন ও সায় নেই। বরং আছে দায়িত্ববোধ থেকে বিবেক পীড়া এবং এ নিয়ে নিন্দা, সমালোচনা। রাজনীতির প্রথম ও প্রধান বাণিজ্য নমিনেশন। নির্বাচনে নমিনেশন বাণিজ্যের পর পদপদবির বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি রমরমা, জমজমাট। এরপর ঠিকাদারি, ক্রয়বিক্রয় বাণিজ্য, তারপর তদবির বাণিজ্য। তবে এর বাইরে আরও যে অবৈধ বাণিজ্য তার নাম দখল বাণিজ্য। অর্থাৎ রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বাণিজ্য। এ বাণিজ্য নৈতিক না অনৈতিক, ন্যায় না অন্যায়, তা বিচার-বিবেচনা করেন ক’জন রাজনীতিক? রাজনীতির পুঁজি ধর্ম এবং অসত্য। তবে ঘটা করে সমস্বরে বলা হয় জনসেবা। আসলে আত্মসেবা। আত্মসাৎ-এর আত্মসেবা। যেনতেন প্রকারে রাজনীতির মুখপাত্র হতে পারলে, রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে পারলে, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্ততাড়িত রাজনীতিতে শনৈ শনৈ উন্নতি, অগ্রগতি। একবার এ বাণিজ্য উন্নতির সিঁড়ি মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না কস্মিনকালেও! তখন কেউ ভুলেও বলবে না ‘ফিরে যাই মাটি ও মানুষের টানে’। বলবে ফিরে যাই রাজনীতির অপার সুবিধার মাঝে! কারণ রাজনীতি তাকে দিয়েছে অগাধ ক্ষমতা, বিত্তবৈভব।
বস্তুত সুশাসনের অভাব প্রকট হলে, কখনো জবাবদিহিবোধ তৈরি হয় না। আর স্বেচ্ছাচার এ বোধ তৈরি হতেও দেয় না। আইনের শাসনের অনুপস্থিতি অনৈতিক বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ তৈরি করে। আর দলীয়করণের মাধ্যমে এই বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয় ব্যাপকভাবে ও চক্রবৃদ্ধি হারে। অর্থাৎ দলীয় রাজনীতির আনুগত্য এবং অন্যায় প্রভাব সব বাণিজ্যের সূতিকাগার। নীতিহীন রাজনীতিতেই অবৈধ বাণিজ্য- পথের সুগম বিস্তার। মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ যে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে, তা তো এই মহাদুর্নীতি বাণিজ্যের কারণেই! আমরা বুঝে না বুঝে এই দুর্নীতির বাণিজ্যকেই কিন্তু সমর্থন দিচ্ছি উন্নয়নের নামে! তবে শুধু মহাসড়কের কথা বলি কেন?
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি, শিল্প, কৃষি, আইন, যোগাযোগ- কোথায় এ বাণিজ্য নেই? এসব জায়গায় যে দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা, তা কি ভাঙা যাচ্ছে, যাবে? বাণিজ্যের যে অবাধ সুযোগ এবং সুবিধা, তাতে সবকিছু ছাপিয়ে রাজনীতি সামনে চলে আসে। দুর্নীতি যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির আঁতুড়ঘর, তা কি বাস্তবতার নিরিখে অস্বীকার করা যাবে? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অজস্র জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত একটা স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ এভাবে অবৈধ বাণিজ্যের অবাধ প্রবাহে কলঙ্কিত হবে? তলিয়ে যাবে?
এ রাজনীতির তাহলে গ্রহণযোগ্যতা কী! মানুষ রাজনীতির নামে এই স্বেচ্ছাচার, লুটপাট অপকর্মই দেখতে থাকবে অবাক বিস্ময়ে? নীতিহীন রাজনীতিই এই অবাধ বাণিজ্যের পথ খুলে দিচ্ছে। আর নির্বিরোধ দলনিরপেক্ষ অরাজনৈতিক মানুষ এই বাণিজ্যের অসহায় শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন, কবে কীভাবে এই বাণিজ্যের করুণ গ্রাস থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পাবে? রাজনীতি বলতে বোঝাত জনসেবা কিন্তু এখন যে আত্মসেবা দেখছে মানুষ, তাতে রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ ও বিমুখ হওয়াই তো স্বাভাবিক।
প্রবাদ আছে ‘আপন মাংসে হরিণা বৈরী’ কিন্তু রাজনীতির বাণিজ্য এখন অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। দখল বাণিজ্য ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে প্রতিদিন সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এক গ্রুপ আর এক গ্রুপের আধিপত্য খর্ব ও অস্তিত্ব বিনাশে মরিয়া। আমরা সুষ্ঠু সুন্দর পরিচ্ছন্ন এবং নির্মল আদর্শের রাজনীতিক ও রাজনীতি চাই। যে রাজনীতির আদর্শ হবে জনকল্যাণ, জনসেবা এবং অবৈধ বাণিজ্যমুক্ত। জনমনে শান্তি ও স্বস্তি আনাই হোক সেই রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
লেখক : সাংবাদিক