সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে মোট ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ব্যয় এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বাকি অর্থ ব্যয় করেছে সম্মেলনের সহযোগীরা। আর এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ৩১০০ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।
রবিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বিন মাহমুদ হারুন।
তিনি বলেন, তবে এই সম্মেলন কতটা সফল তা এখনই বলা যাবে না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমরা শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি।
এর আগে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বিডা ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১০টি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে পাঁচটি সরকারি এবং পাঁচটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এছাড়া, বিমানের থার্ড টার্মিনাল দ্রুত চালু এবং বাংলাদেশের বন্দরগুলোকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সম্প্রতি ভারত সরকার বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। নেপালের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত চালু হবে বে-টার্মিনাল।
এ সময় গত ৭-১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে মোট পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খরচ এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং সহযোগীদের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
সম্মেলনে তাৎক্ষণিকভাবে দুই প্রতিষ্ঠানের ৩১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বলে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং বিডার হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নাহিয়ান রহমান বক্তব্য রাখেন।
এতে জানানো হয়, গুরুত্ব বিবেচনায় রবিবারের বৈঠকে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল করা হয়েছে। বাতিল করা সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে, কক্সবাজারের সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক, বাগেরহাটের সুন্দরবন ট্যুরিজম পার্ক, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, গাজীপুরের শ্রীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
বেসরকারি মালিকানায় পাঁচটি অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে, গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর মালিকানায় মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্টস শিল্প পার্ক, সুনামগঞ্জের ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাগেরহাটের ফমকম অর্থনৈতিক অঞ্চল, ঢাকার সিটি স্পেশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চল।
আশিক চৌধুরী বলেন, এছাড়া, নেপালের জন্য আলাদা একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, আগামী অক্টোবরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু করার কথা ছিল। এটি আরও কত দ্রুত চালু করা যায়, সেই ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া, অন্যান্য বিমানবন্দরগুলো সচল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দর, সিলেট বিমানবন্দর ও লালমনিরহাট বিমানবন্দর অন্যতম।
তিনি বলেন, সরকারি আটটি এজেন্সি বর্তমানে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এক ছাদের নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন ড. ইউনূস। বর্তমানে এজন্য কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে যারা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয় সরকার। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তাদেরও এক রকম প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান বিডায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু রয়েছে। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে অনেকগুলো সেবা পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে কোনোটি ম্যানুয়াল এবং কোনোটি ডিজিটাল। যেসব প্রতিষ্ঠানে ম্যানুয়াল এবং ডিজিটাল দুটি সেবাই রয়েছে। সেক্ষেত্রে আগামী এক মাসের মধ্যে ম্যানুয়াল সেবা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। অর্থাৎ সব সেবা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প কত দ্রুত চালু করা যায়, সেই ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে সব মিলিয়ে চার দিনের এই সম্মেলনে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। তবে খরচের হিসাব দিয়ে সামিটকে মূল্যায়ন করা যাবে না। বিনিয়োগের সব ক্রেডিট এই সামিটের নয়, এটা আগে থেকে চলতে থাকা আলোচনার ভিত্তিতে হয়েছে। সামিটে এসেই বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে দিবেন বিষয়টি এমন নয়। তাই এটাকে সামিটের সফলতা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। সামিটের খরচ দিয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বিচার করলে হবে না। এখানে ৬টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষও হয়েছে।
নাহিয়ান রহমান বলেন, এবারের সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। সম্মেলনের উদ্বোধনের দিন মোট অংশগ্রহণকারী ছিলেন ৭১০ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এবার ৫০টি দেশ থেকে ৪১৫ জন বিদেশি ডেলিগেট অংশ নিয়েছেন। বাকি ৩৯৪ জন দেশি বিনিয়োগকারী। অর্থাৎ সংখ্যার দিক থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ৫৮ শতাংশ। তবে, চার দিনের অনুষ্ঠানে মোট সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি অংশ নেন। এর মধ্যে প্যানেলিস্ট ছিলেন ১৩০ জন। সামিটে মোট ১৫০টি অফিসিয়াল মিটিং হয়েছে।
তার মতে, দেশের মানুষের সহনশীলতা, বিনিয়োগ সম্ভাবনার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে বিদেশিরা উচ্ছ্বসিত। সামিটের সফলতা নিয়ে বিডা চিন্তিত নয়। বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরাই ছিল সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এর চেয়েও ভালো সামিট করা যেত। সেটি হতেই পারে। এটা কতখানি সফল হয়েছে সেটি বুঝতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের ধারণা বদলানো যায় কিনা। সামিটে অংশ নেওয়ার পর যে ধারণা নিয়ে তারা ফেরত গেছেন, তা আমাদের জন্য খুবই ইতিবাচক। কেননা বাংলাদেশকে জানার জন্য গুগল করলে তারা যা জানতে পারেন... সশরীরে এসে যা দেখেন এবং জানেন তা পুরোটাই বিপরীত। আমরা সেটাই চেষ্টা করেছি যে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশটা কেমন সেটা আপনারা জানুন। এজন্য আমরা তাদেরকে বিভিন্ন এলাকা তথা দেশটা পরির্দশন করিয়েছি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আশিক চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হলো কমন অ্যাজেন্ডা। সব সরকারই এটা চাইবে। সব রাজনৈতিক দলও সেটাই চাইবে। সেজন্য আমরা এই সামিটে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পদের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। যারা প্রথমবার এসেছিলেন। তারা দেশটাকে জেনে গেছেন। তারা বলেন, গেছেন যারা আসেন নাই তাদের আরও আনা দরকার। বাংলাদেশ নিয়ে একটা নেগেটিভ ও ন্যারেটিভ প্রচারণা রয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার বন্যা, খরা আক্রান্ত গরিব দেশ। কিন্তু তারা তো এসে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন।
বিডি প্রতিদিন/কেএ