বাংলায় হিজরি সনবাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। মুসলমানরাই বাংলা সনের প্রবর্তক। বাংলা সন হলো ইসলামি হিজরি সনের সৌরবর্ষীয় সংস্করণ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় হিজরি সনের শুরু। বাংলা সনের সঙ্গে রয়েছে মহানবী (সা.)-এর হিজরতের সেই পবিত্র স্মৃতি। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর হিজরি সন অনুসরণ করা হতো। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের উৎস ঠিক রেখে সৌরবর্ষীয় বাংলা সনের উৎপত্তি। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সন শুরু হয়। সে সময় কৃষককে হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা দিতে হতো। হিজরি চান্দ্রবছরের সঙ্গে বাংলা ঋতুচক্রের হিসাব এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় কৃষক বিপাকে পড়ে যেত। সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ করে এ সমস্যাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯১২ হিজরি সনে প্রখ্যাত ইরানি জোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজিকে সৌরবর্ষীয় সন তৈরির দায়িত্ব দেন। আমির ফতেহ উল্লাহ হিজরি সনের সঙ্গে মিল রেখে সৌরমাসভিত্তিক ফসলি সন প্রণয়ন করেন। এ সন হিজরি সনের আদলেই শুরু হয়। ৯৩৬ হিজরি সন বাংলা সনের জন্ম বছর হলেও তা ৯৩৬ বঙ্গাব্দ হিসেবে গণনা শুরু করা হয়। শুধু তা-ই নয়, হিজরি সনের সঙ্গে মিল রাখার জন্য বাংলা সনের প্রথম মাস চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখ করা হয়। কারণ ৯৩৬ হিজরি সনের পয়লা মহররমের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের মিল ছিল। সে থেকেই পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
সুতরাং বলা যায়, বাংলা সনের সঙ্গে ইসলামি ঐতিহ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব ধর্মের মানুষের কাছে এ সন অনুসরণীয় হলেও সৌরবর্ষীয় বাংলা সন চান্দ্র আরবি হিজরি সনের উত্তরাধিকার। চন্দ্র-সূর্য সবকিছুই যেমন আল্লাহর সৃষ্টি তেমন চান্দ্রবর্ষ বা সৌরবর্ষ- যেভাবেই সময়কে ভাগ করা হোক না কেন, সবকিছুর নিয়ন্তা মহান আল্লাহ। পবিত্র কোরআনের সুরা আম্বিয়ার ৩৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘(আল্লাহ হচ্ছেন) তিনিই যিনি সৃষ্টি করেছেন রাত, দিন, চন্দ্র ও সূর্য। এদের প্রত্যেকেই পরিভ্রমণে নিয়োজিত রয়েছে নিজ নিজ কক্ষপথে, নিজস্ব গতিবেগসহকারে।’ এ বিষয়ে সুরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সূর্য কখনোই চন্দ্রকে ধরতে পারবে না কিংবা রাত কখনো অতিক্রম করতে পারবে না দিনকে। প্রত্যেকেই পরিভ্রমণে নিয়োজিত নিজ নিজ কক্ষপথে, নিজস্ব গতিবেগসহকারে।’
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে আল্লাহ তাঁর খলিফার মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর হাবিবকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের মধ্য থেকে। মানুষের উচিত আল্লাহপ্রদত্ত সময় অর্থাৎ দিন, রাত ও বছরকে মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথে অতিবাহিত করা। এ বিষয়ে গাইডলাইন রয়েছে আল কোরআনের বিভিন্ন সুরায়। সুরা ফাতিহায় সরল পথ পাওয়ার জন্য এবং বিপথগামীদের পথ থেকে রক্ষা পাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ সুরার ৫-৭ আয়াতে আছে, ‘তুমি আমাদের সরল পথ দেখাও, তাদের পথ যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছ, তাদের পথ নয়- যারা ক্রোধে নিপতিত ও পথভ্রষ্ট।’ মানবজাতির সবারই আল্লাহর রহমত যে পথে সে পথ অনুসরণ করা উচিত। সুরা বাকারার তৃতীয় আয়াতে রয়েছে, ‘সৎ জীবিকা থেকে ব্যয় করার আদেশ সৃষ্টিকর্তার।’
এ ব্যাপারটি প্রত্যেক মানুষ মেনে চললে পৃথিবীতে একটি সুষম সমাজ গড়ে উঠবে। সম্পদ বণ্টনে ভারসাম্য হবে। অসৎ উপার্জন থেকে মানুষ বিরত থাকলে পৃথিবীতে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ৪২ নম্বর আয়াতে রয়েছে, ‘মিথ্যার সঙ্গে সত্য না মিশিয়ে ফেলার আদেশ এবং জেনেশুনে সত্য গোপন না করার কথা।’ আল কোরআনের এ ঐশী শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন ও চর্চা মানুষকে সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে এমনটি কাঙ্ক্ষিত। ৬০ নম্বর আয়াতেই রয়েছে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি না করার উপদেশ। আজকের এ সময়ে যে নির্দেশনার অনুসরণ আমাদের অবশ্যকর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। আল কোরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষকে যেভাবে চলার উপদেশ দিয়েছেন সেভাবে চলার মধ্যে রয়েছে সত্যিকারের জাগতিক ও আখেরাতের শান্তি। আল্লাহ আমাদের নতুন বছরের প্রতিটি দিন তার নির্দেশিত পথে চলার সুযোগ দান করেন সে জন্যে আমাদের যত্নবান হতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ