শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১১ মাস পার হলেও এখনো নিখোঁজ ১৮৭ জন পুুলিশ সদস্য। কাজে যোগ না দেওয়া পুলিশ সদস্যের বেশির ভাগই কোনো না কোনো মামলার আসামি। তাদের কেউ জামিনে গিয়ে ফেরেননি, আবার কেউ ছুটি নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের মামলা পুলিশেরই বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করলেও তাতে খুব একটা অগ্রগতি নেই। পলাতক থেকেও অনেক সাবেক কর্মকর্তা পুলিশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, হদিস না থাকা পুলিশ সদস্যদের অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশালসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে কর্মরত ছিলেন। তিন মাস ধরে কাজে যোগ দেননি পুলিশ একাডেমি সারদায় কর্মরত থাকা পুলিশ সুপার (প্রশাসন এবং লজিস্টিক) তারেক বিন রশীদ এবং তার স্ত্রী রংপুর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে থাকা পুলিশ সুপার হুমায়রা পারভীন। তারা ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। একই তালিকায় রয়েছেন ২৪ ব্যাচের অতিরিক্ত ডিআইজি দম্পতি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ও সুনন্দা রায় দম্পতি। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত এ সংখ্যা ১৮৭। তবে এর মধ্যে অনেকে বরখাস্ত এবং বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন। যাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে কিংবা যারা বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তদন্ত হচ্ছে।
একাধিক সূত্র বলছে, সরকার পতনের পর পলাতক থাকা বেশির ভাগই সরকার পতনের আগমুহূর্তে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন-পীড়নে সক্রিয় ছিলেন এমন ১৩৩ জনকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর এবং ওএসডি করা হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা সরাসরি চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কর্মকর্তার সংখ্যা ৫১ জনের মতো। বাধ্যতামূলক অবসর এবং ওএসডি হওয়া কর্মকর্তার অনেকেই বিতর্কিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন জেলার এসপি, রেঞ্জ ডিআইজি ও মেট্রোপলিটন কমিশনার ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অপরাধ তদন্ত বিভাগের সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। অবসরে যাওয়ার আগে তাঁদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা এসব পুলিশ সদস্যের বেশির ভাগই ভারতে, ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া ১৮৭ সদস্যের মধ্যে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৬ জন। পুলিশ পরিদর্শক আছেন পাঁচজন, উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৪ জন। অন্যদের মধ্যে এএসআই ৯ জন, নায়েক সাতজন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান (স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করেছেন), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী ও সঞ্জিত কুমার রায়, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
এসপি থেকে এএসপি পদমর্যাদার আত্মগোপনে থাকা অন্য আট কর্মকর্তা হলেন আরপিএমপির উপকমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপির ডিবির উপকমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সাবেক এডিসি মো. রওশানুল হক, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার জন রানা। পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির সাবেক পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন। সম্প্রতি ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ গুলশান থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহমুদুর রহমান মঞ্জু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে ফেরার কথা থাকলেও চার মাস পেরিয়ে গেছে, এখনো ফেরেননি। জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে এ পর্যন্ত ৭৬১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির তালিকায় পুলিশের সাবেক দুজন আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত ১ হাজার ১৬৮ সদস্যও রয়েছেন। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৪২ জন। তবে ঘটনার প্রায় ১১ মাস পরও কোনো মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য তদন্ত চলছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব তদন্ত প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘসূত্রতায় নিমজ্জিত। কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এখনো চার্জশিট দাখিল হয়নি, নেই গ্রেপ্তারের উদ্যোগও। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও আইন সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন সময় বিবৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে, আইনের রক্ষকদের বিচারের বাইরে থাকার সুযোগ থাকা মানে দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক করা। এই প্রবণতা থামাতে না পারলে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।