চীন বাংলাদেশকে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও এর সুফল নিতে পারেনি বাংলাদেশ। কারণ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগ (ট্রানজিট) কার্যকর করা যায়নি। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দেয়। সরকার নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধার পাশাপাশি ভারতের স্থলপথ ব্যবহার করে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পণ্য রপ্তানির সুযোগ চায়। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে এ বিষয়ে একাধিকবার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো তা কার্যকর হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে যে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা কার্যকর হয়েছিল, তা থেকে সুফল পায়নি বাংলাদেশ। এর সঙ্গে চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারত। বাংলাদেশ এ বিষয়ে ভারতকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলেও তা কার্যকর হয়নি। শুধু তাই নয়, ভারতের চিকেন নেক অঞ্চলের শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে নেপাল ও ভুটানের পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি বাংলাদেশে আসার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ বারবার অনুরোধ করেও ওই করিডর ব্যবহার করে পণ্যবাহী ট্রাক নেপাল ও ভুটানে নিয়ে যেতে পারেনি।
এ কারণেও দেশ দুটির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়নি। সাম্প্রতিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট সম্পর্কে যুক্ত ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ এই চার দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৪৫০ কোটি ডলার। বাকি ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলারের বাণিজ্যের অর্ধেক ভারতের। বাকি অর্ধেক নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশ ভারতে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে, তার পাঁচ গুণ বেশি রপ্তানি করছে ভারত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করেছে ৯৭০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। বিপরীতে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। এমনকি ল্যান্ডলক কান্ট্রি নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশে যে পরিমাণ রপ্তানি করে দেশ দুটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির তুলনায় তা অনেক বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৭৭ কোটি মার্কিন ডলার। বিপরীতে দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৭২ কোটি মার্কিন ডলারের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ সম্পর্ক কার্যকর হয়েছিল, বাংলাদেশ চেয়েছিল সেটির আরও সম্প্রসারণ। বিশেষ করে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকি চীনেও পণ্য রপ্তানির সুযোগ চেয়েছিল বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তির আওতায় এক দেশ আরেক দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। তবে এই তৃতীয় দেশ বলতে নেপাল-ভুটানের সঙ্গে সংযোগ নিয়েই আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান নিয়ে চারদেশীয় আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিবিআইএন চুক্তি নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের যুক্তি ছিল, শুধু নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে ট্রানজিট কার্যকর করলে সেটি বাণিজ্যিকভাবে খুব বেশি লাভজনক হবে না। কারণ, এ দুটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে দেশটির সঙ্গে সীমানা রয়েছে এমন তিনটি দেশ চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ট্রান্সশিপমেন্ট সুযোগ চায় বাংলাদেশ। পরে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব চাইলে, ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত জেটিসির বৈঠকে বাংলাদেশ-নেপাল, ভুটানের পাশাপাশি চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও ট্রান্সশিপমেন্ট দিতে ভারতকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ জানায়, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে- এমন সব দেশের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী। তবে এ প্রস্তাব কাগজে-কলমেই থেকে যায়। এর বদলে বাংলাদেশ যেটি পেয়েছিল, ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করে আকাশপথে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের (ট্রান্সশিপমেন্ট) সুযোগ, যে সুবিধা গত সপ্তাহে বাতিল করেছে দেশটি।
দক্ষিণ এশিয়ায় উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ সম্পর্ক নিয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)’র নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ট্রানজিট বলতে যা বোঝায়-অর্থাৎ একটি অঞ্চল বা উপ-অঞ্চলের মধ্যে সড়ক, নৌপথ, আকাশপথ এবং রেলপথে বহুমুখী ও কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা; বিগত সময়ে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগব্যবস্থা এবং আংশিকভাবে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্ক বলা যেতে পারে। এ থেকে বাস্তবিক অর্থে তেমন কোনো সুফল নিতে পারেনি বাংলাদেশ।