২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। এ হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন। নির্মম এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা দুটি মামলার বিচার শেষ হয়নি দুই যুগেও। হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানিও শেষ হয়েছে। এখন রায় ঘোষণার অপেক্ষায়। অন্যদিকে বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি থমকে আছে নিম্ন আদালতেই।
২০১৪ সালে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুকও (রায়সহ যাবতীয় নথিসংবলিত বই) তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে প্রথম শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি শুরুও হয়। পরে কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। আলোচিত এই মামলায় আট আসামির ডেথ রেফারন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিল হাই কোর্টের তিনটি বেঞ্চের কার্যতালিকায় উঠলেও শুনানি শেষে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় ওঠে এই ডেথ রেফান্সে ও আপিল। পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মামলাটির শুনানি শেষ করে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন। আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও সরওয়ার আহমেদ এবং আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই ডেথ রেফারেন্স মামলাটি দীর্ঘদিন হাই কোর্টে ঝুলে ছিল। সর্বশেষ বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাই কোর্ট বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেছেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছেন আদালত। এখন আদালতই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কবে রায়টি ঘোষণা করবেন।
ঢাকার আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাই কোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে দীর্ঘদিন বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ থমকে ছিল। ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর ২০২১ সালে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তৎপরতায় ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ওই ট্রাইব্যুনালেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে দ্রুত বিচার আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেশি থাকায় ২০২৩ সালের মার্চে বিস্ফোরক মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর সপ্তম আদালতে পাঠানো হয়। বর্তমানে ওই আদালতে মামলার বিচার থমকে আছে। আগামী ২০ এপ্রিল মামলাটি আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য রয়েছে। জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মাহফুজ হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত অক্টেবরে আমরা নিয়োগ পেয়েছি। ডিসেম্বরে ছিল অবকাশ। আমরা খুব বেশি দিন সুযোগ পাইনি। রাষ্ট্রীয় দিক-নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের পিপি স্যার আছেন। তাকে সব সময় ইনফর্ম করি। পিপি স্যার যে দিক-নির্দেশনা দেবেন সে অনুযায়ী কাজ করব।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়।
পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছর ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদ দেওয়া হয় ছয় আসামিকে। মৃত্যুদ ও যাবজ্জীবন কারাদ প্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ ও দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় ১৪ আসামির চারজন শুরু থেকেই পলাতক। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাই কোর্টে আসে।