ইরানে মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানের হামলার পর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিও আরও বিস্তৃত হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক পদক্ষেপ পিয়ংইয়ংকে তাদের অস্ত্র কর্মসূচিকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে বলেই মনে করছেন তারা। এ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।
কিম জং উন বিশ্বাস করেন পারমাণবিক অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের শাসনের পরিবর্তন রুখতে চূড়ান্ত প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। বছরের পর বছর ধরে উত্তর কোরিয়াকে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করতে বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ধারণা করা হয়, কিম প্রশাসনের কাছে এমন কাছে একাধিক পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর মতো ক্ষমতা রাখে। এর মানে কোরীয় উপদ্বীপে যেকোনো সম্ভাব্য সামরিক হামলা অনেক বেশি ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ংনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর কোরিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক লিম ইউল-চুল বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা নিঃসন্দেহে উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের শাসন টিকিয়ে রাখা এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
লিম আরও বলেন, উত্তর কোরিয়া সাম্প্রতিক মার্কিন বিমান হামলাকে একটি পূর্বপরিকল্পিত সামরিক হুমকি হিসেবে দেখছে এবং সম্ভবত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা জোরদার করবে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, ইউক্রেনে মস্কোর আগ্রাসনের পর রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সামরিক সম্পর্ক ক্রমশ বাড়ছে এবং এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া দ্রুত পারমাণবিক সক্ষমতা আরও বাড়াতে পারে।
২০২৪ সালের পর থেকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পিয়ংইয়ংয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক লাইফলাইনে পরিণত হয়েছে।
লিম বলেন, উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে কৌশলগত জোটের ভিত্তিতে পিয়ংইয়ং যৌথ অস্ত্র তৈরি, সম্মিলিত সামরিক মহড়া, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই বৃহত্তর পারস্পরিক নির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাবে।
জাতিসংঘের ১১ সদস্য নিয়ে গঠিত মাল্টিল্যাটারাল স্যাংশনস মনিটরিং টিমের (এমএসএমটি) প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার আক্রমণে সহায়তার জন্য ১৪ হাজারের বেশি সৈন্য এবং ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটসহ লক্ষ লক্ষ সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে।
এর বিনিময়ে রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে বিভিন্ন মূল্যবান অস্ত্র ও প্রযুক্তি দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা এবং পরিশোধিত তেল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপগুলো উত্তর কোরিয়াকে তার সামরিক কর্মসূচিতে অর্থায়ন করতে এবং তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করছে। যা দেশটিকে আধুনিক যুদ্ধে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সহায়তা করে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের কোরিয়া চেয়ার ভিক্টর চা বলেন, কিমের চোখে ইরানের সাম্প্রতিক মার্কিন সামরিক পদক্ষেপগুলো একটি উদ্বেগজনক বিষয়। ইরাক ও লিবিয়া থেকে ইরান পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন দেশগুলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন হস্তক্ষেপের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তর কোরিয়া, ইতিমধ্যে ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে এবং দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে।
চা এর মতে, তেহরানের পারমাণবিক সম্পদের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের বিমান হামলা কিম শাসনের উপর একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলবে। তিনি বলেন, ইরানের ওপর হামলা উত্তর কোরিয়ার জন্য দুটি বিষয়কে নিশ্চিত করবে, যার কোনটিই মার্কিন নীতির জন্য ভালো নয়। এক, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য ইসরায়েলের মতো বল প্রয়োগের বিকল্প নেই। দুই, এই হামলা কিম জং উনের মনে পারমাণবিক অস্ত্রাগার সমৃদ্ধ করা ও বজায় রাখার দৃঢ় বিশ্বাসকে আরও গাঢ় করবে।
আর ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট, বিশেষ করে পারমাণবিক সক্ষমতার দিক থেকে।
সিউলের ইওহা ওম্যানস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অধ্যাপক লিফ-এরিক ইজলি বলেন, পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক কর্মসূচি অনেক বেশি উন্নত, একাধিক ডেলিভারি সিস্টেম, যার মধ্যে আইসিবিএম (আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র) রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে অস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, কিম শাসন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানার হুমকি দিতে পারে এবং সিউল উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রের সীমার মধ্যে রয়েছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুসারে, ইরান এখনও একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারেনি এবং তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অস্ত্র তৈরির মাত্রার নিচে ছিল।
তারা পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে কূটনীতি চালিয়েছিল, যা ট্রাম্প বি-২ স্টিলথ বিমানকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার বাস্টিং বোমা ফেলার নির্দেশ দেওয়ার সময়ও চলমান ছিল।
ধারণা করা হয়, উত্তর কোরিয়ার কাছে ৪০ থেকে ৫০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যা আঞ্চলিক এবং সম্ভাব্যভাবে মার্কিন মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম।
কিয়ংনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লিম সতর্ক করে বলেন, উত্তর কোরিয়ার উপর হামলা পূর্ণ মাত্রার পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন-দক্ষিণ কোরিয়া জোট চুক্তি অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক পদক্ষেপের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সঙ্গে পূর্ব পরামর্শের প্রয়োজন হবে, যা রাজনৈতিক ও আইনি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
এছাড়াও বাহ্যিক শক্তি বিবেচনা করার বিষয়ও আছে। লিম বলেন, উত্তর কোরিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যা রাশিয়াকে আক্রমণের ঘটনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দেয়।
পারমাণবিক সক্ষমতা, মার্কিন আঞ্চলিক জোট এবং রাশিয়ার সমর্থন; এই প্রতিরোধের সমীকরণ সম্ভবত পিয়ংইয়ংকে এমন একতরফা সামরিক পদক্ষেপ থেকে রক্ষা করে, যা ওয়াশিংটন ইরানে প্রয়োগ করেছে।
লিম বলেন, শেষ পর্যন্ত ইরানের উপর এই হামলা পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে কাজ না করে বরং এর ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারে।
তিনি বলেন, এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি উত্তর কোরিয়ার অবিশ্বাসকে আরও গভীর করবে এবং উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা জোরদার ও গভীর করার মাধ্যমে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল