আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)-এর ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্প খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনিয়ম আর দুর্নীতির সন্দেহে এ উদ্যোগ নিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এর আগে বিষয়টির ওপর বিশেষ একটি প্রতিবেদন দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন পলিসি অ্যাডভাইজার ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। বর্তমানে তিনি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা ফাইভজি উপযোগী অপটিক্যাল ফাইবার (বিশেষ তার) বসানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর মাধ্যমে জেলা ও উপজেলাকে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের আওতায় আনার কথা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। সরঞ্জাম কেনার ব্যয় ৪৬৩ কোটি টাকা।
সরঞ্জাম কেনার দরপত্রে প্রস্তাব দাখিল করে তিনটি কোম্পানি জেডটিই করপোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড ও নকিয়া সলিউশন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করে হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড, ৩২৬ কোটি টাকা। এরপর জেডটিই করপোরেশন ৪১৫ কোটি ও নকিয়া সলিউশন ৫৭৯ কোটি টাকা। প্রথম ও দ্বিতীয় কোম্পানির মধ্যে ব্যবধান ৯০ কোটি টাকা। সাত সদস্যের কারিগরি কমিটি এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই যোগ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে এবং যোগ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কার্যাদেশ পায় হুয়াওয়ে।
প্রকল্প নিয়ে দেওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে তিনটি অভিযোগে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে সাবেক ডাক ও টেলিকম সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান বোর্ড মিটিংয়ের আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চায়নিজ ভেন্ডর হুয়াওয়ের অনুকূলে টেন্ডার অফার করেছেন। বিটিসিএল সচিব সঠিকভাবে ভেন্ডর সিলেক্ট করলেও বিটিসিএল এমডি অন্যদের প্ররোচনায় প্রতিবাদ করেন। তাঁকে দায়িত্ব থেকে ওএসডি করা হয়। রিট/আপিলে জেতার পরও এমডিকে বিটিসিএল থেকে ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম বা ডটে বদলি করা হয়। পরে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা আছে এ অভিযোগ সামনে এনে প্ল্যানিং কমিশন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে পরামর্শ দেয়। বিশেষ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লেখ্য যে, ৭১ টেলিভিশনের মোজাম্মেল বাবুর সংশ্লিষ্টতা, হুয়াওয়ের পক্ষে ২০ কোটি টাকা লেনদেন বিষয়ে প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্ট যাচাই (দৈনিক মানবজমিন, ডেইলি স্টার) করা হয়। আরও উল্লেখ্য যে, বিটিসিএল সম্প্রতি আইসিএক্স এ কাজ বাতিল করেছে হুয়াওয়ের। সেখানেও মোজাম্মেল বাবুর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে অভিযোগ আছে। প্রতিবেদনে প্রকল্পের ওপর আইনি দিক যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিষয়টির ওপর লিগ্যাল ভেটিং দরকার। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় টেন্ডার ইভালুয়েশন হয়েছে কি না, টেন্ডার প্রক্রিয়া কোনো পক্ষ প্রভাবিত করেছে কি না; এসব খতিয়ে দেখা দরকার। এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বিটিসিএল এমডিকে ডিবিতে ডেকে নেওয়ার ঘটনা কারা করেছে? এর সঙ্গে বিটিসিএলের বর্তমান বোর্ড বা বোর্ডের কোনো সদস্য কিংবা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের পক্ষের কিংবা দ্য ডেইলি স্টারের প্রকাশকের কোনো আত্মীয়ের সংযোগ রয়েছে কি না? প্রকাশিত রিপোর্টের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের সংযোগ আছে কি না এসব যাচাই ও তদন্ত করা উচিত। প্রতিবেদনে কারিগরি দিক পর্যালোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ফাইভজির নাম করে থ্রিজি ইকুইপমেন্ট কেনার আয়োজন হয়েছে কি না, সি ক্যাটাগরির ইকুইপমেন্ট কি না তা আমলে নেওয়া দরকার। প্রতিবেদনে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়ার কথা বলা হয়। সেখানে বলা হয়, যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ৫ আগস্টের আগে ও পরের উভয় সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পক্ষের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িত সব পক্ষের শক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সাবেক সচিব, বিটিসিএল বোর্ড, ভেন্ডর এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী তিন ভেন্ডরের পক্ষে প্রভাব খাটানো পক্ষগুলোকে বড় রকমের আর্থিকসহ বিচারিক শাস্তি দেওয়া যেতে পারে; যাতে ডাক, টেলিকম ও আইসিটি খাতের টেকনিক্যাল প্রকল্পে ভেন্ডর ও ভেন্ডর সমর্থিত পক্ষগুলো টেন্ডারসংক্রান্ত অপরাধে জড়াতে না পারে। উল্লেখ্য, হুয়াওয়ের পক্ষে মোজাম্মেল বাবু ও সাবেক টেলিকম সচিব, জেডটিইর পক্ষে বিটিসিএল বর্তমান বোর্ড মেম্বার ও ডেইলি স্টারের সম্পাদকের আত্মীয়ের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ এসেছে। বাংলাদেশে দুই চায়নিজ ভেন্ডর হুয়াওয়ে ও জেডটিই, চায়নিজ ও ইউরোপীয় ভেন্ডরগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার অভিযোগ দীর্ঘ। দেশের ডাক, টেলিকম ও আইসিটি ইত্যাদি কারিগরি সেক্টরে কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের একচেটিয়াত্ব বা মনোপলি ও তদ্জনিত সিঙ্গেল পয়েন্ট অব ডিপেনডেন্সি বা সম্ভাব্য সংকটে কোনো কৌশলগত প্রভাব যাতে না পড়ে তার জন্য দুদক, আদালত এবং বিটিআরসির যৌথ নির্দেশনা ও নীতিমালা চাওয়া যেতে পারে।