টানা ১৬ বছর কারাবন্দি জীবনে জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি, শেষবারের মতো বাবাকে দেখতে পারিনি, বাবার কবরে এক মুঠো মাটিও দিতে পারিনি, এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার জীবনে আর নেই। এই দীর্ঘ বন্দিজীবনে আপন তিন চাচা, দুই মামা, দুই মামি ও তিন চাচাতো ভাইকে হারিয়েছি, এই কষ্ট কাকে বোঝাব। কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া হাবিলদার মো. সোলায়মান মিয়া। শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের কেন্দুয়াই গ্রামে গিয়ে কথা হয় হাবিলদার মো. সোলায়মান মিয়ার (৬৪) সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৮১ সালের আগস্টে বিডিআরে যোগ দেন তিনি। চাকরিজীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেই স্বপ্নকে আর বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার সময় পিলখানা সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন তিনি। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ জেলে যেতে হয় সোলায়মানকে। একই বছরের আগস্টে বাবা ফজলুল হক সরদার মারা যান। বাবার মৃত্যুর দেড় মাস পর খবর পান তিনি। হাবিলদার সোলায়মান মিয়া আরও বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিডিআর হত্যা মামলায় আমি খালাস পাই। পরে বিস্ফোরক মামলায় আমাদের আটক দেখানো হয়। পিলখানার ঘটনার দিন আমি ভিতরে ডিউটিরত ছিলাম। পিলখানার হত্যাকান্ডের ঘটনায় আমি বিন্দুমাত্র জড়িত নই। সেই সময় আমি নিজের জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিলাম। বিনা অপরাধে আমাকে ১৬ বছর কাটাতে হয়েছে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এই বিচার কার কাছে দেব। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় বাবার মৃত্যুর খবর জানতে পারি দেড় মাস পর। জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি, শেষবারের মতো বাবাকে দেখতে পারিনি, বাবার কবরে এক মুঠো মাটিও দিতে পারিনি।
দীর্ঘ ১৬ বছর কারা ভোগের পর মুক্তি পাওয়ায় তিনি আন্দোলনে থাকা ছাত্র-জনতা ও বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি হারানো চাকরি ফিরে পাওয়া ও পুনর্বাসনে সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন। হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী কোহিনুর বেগম বলেন, ১৬ বছর দুই ছেলেকে নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটিয়েছি। অন্যের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সংসার চলেছে। ১৬ বছর আমি কি যে এক অন্ধকার জীবন পাড়ি দিয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। সোলায়মানের ছোট ভাই ইসমাইল সরদার জানান, ১৬ বছর পর বর্তমান সরকারের মাধ্যমে আমার ভাই বাড়িতে এসেছেন। এতে আমরা অনেক খুশি। বর্তমান সরকারের কাছে আমি দাবি জানাই, তাঁর চাকরিজীবনের প্রাপ্যটুকু যেন তিনি বুঝে পান। হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা জুলেখা খাতুন ছেলেকে কাছে পেয়ে খুবই খুশি। তিনি বলেন, নামাজের চাটিতে বসে ছেলের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। ছেলেকে জীবদ্দশায় দেখতে পারব কখনো ভাবিনি। আজ আমি অনেক খুশি, আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে এসেছে।