দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামুক্ত হয়েছে বনানীর সেই ৫৪ প্লট। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ৫৪ প্লটের কার্যক্রম শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এখন থেকে বনানীর ওই প্লটগুলোর হস্তান্তর, বন্ধক, নামজারি, নকশা অনুমোদনসহ দাপ্তরিক কোনো কাজে বাধা থাকছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। জানা যায়, ১৯৬৩ সালের ১৮ অক্টোবর বনানী আবাসিক এলাকার ২ নম্বর রাস্তা সংলগ্ন ৪৮ বিঘা ১৬ কাঠার প্লটটি তৎকালীন ডিআইটি পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (ইপিআইডিসি) কর্মকর্তাদের বাসা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০০২ সালে ন্যাম ভবন তৈরির উদ্দেশে এই ৪৮ বিঘার মধ্যে ২০ বিঘা জমি (বিঘা প্রতি ৮০ লাখ টাকা) রাজউকের অনুকূলে প্রত্যর্পণের জন্য প্রস্তাব দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি বনানী ও গুলশান এলাকায় প্লট বরাদ্দের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজউক। ১০০ প্লটের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ৫৩২টি। এর মধ্যে ১০০ জনকে প্লট দেয় সংস্থাটি। উত্তরা থেকে আরও চারজন প্লট পরিবর্তন করে বনানীতে চলে আসেন। বনানীর ৫৮ প্লটের মধ্যে ৫৪টি দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এর মধ্যে বিএনপির ৪১, জামায়াতের এক, আওয়ামী লীগের একজন। বাকি ১১ জনেরও বেশির ভাগ বিএনপির নেতা ও বিএনপিপন্থি শিক্ষক, ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী।
প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন- বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, সাবেক তথ্যমন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলাম, সাবেক মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকতউল্লা বুলু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল, সাবেক সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম, নিখোঁজ সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী, ফজলুল হক মিলন, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আবদুল হাই, সেলিমা রহমান, প্রয়াত নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, খায়রুল কবির খোকন, মজিবুর রহমান মঞ্জু, মশিউর রহমানসহ ৪১ জন। বাকিরা চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষক।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে বনানী, উত্তরা, বাড্ডাসহ রাজউকের আটটি এলাকার দামি প্লটগুলোর দৈনন্দিন কার্যক্রম স্থগিত করে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজউক চেয়ারম্যানকে যে চিঠি দিয়ে মোট ৭১৪ প্লটের ফাইলের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়, তার তালিকায় ছিল বনানীর ৫৪ প্লটও। ২০১৫ সালের ১৩ মে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বনানীসহ সব প্রকল্প থেকে স্থগিতাদেশ বাতিল করে। ২০১৯ সালে ৫৪ প্লটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সবশেষ গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর রাজউক সদস্যকে (এস্টেট ও ভূমি) আহ্বায়ক করে আট সদস্যের কমিটি করা হয়। এই কমিটি গত বছরের ২৯ আগস্ট ও ২৩ সেপ্টেম্বর ৫৪ প্লটের কার্যক্রম চালাতে পারবে কি না জানতে দুদকে দুই দফা চিঠি দেয়। ১৬ অক্টোবর দুদকের পক্ষ থেকে রাজউককে চিঠি দিয়ে বলা হয়, প্লটগুলোতে কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি। এই কমিটি গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম সভা করে। ২৪ নভেম্বর ও চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি তৃতীয় মিটিং করে কমিটি। সবশেষ মিটিংয়ে ৫৪ প্লটের মালিকের নামে একাধিক প্লট আছে কি না ও দুদকের জব্দ তালিকায় থাকা প্লটগুলো অনুমতি সাপেক্ষে কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আরও জানা যায়, এখন পর্যন্ত সাতজন প্লট মালিক আবেদন করেন। এদের মধ্যে দুজনের একাধিক প্লটের তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ সময় কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর কমিটি বনানীর এ প্লটগুলোর কার্যক্রম শুরু করেছে। যাচাইবাছাই করে একটা সমাধান করা হচ্ছে। কমিটি শুধু সুপারিশ করতে পারে আর কিছু নয়। দেওয়া ও না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বোর্ডের। তিনি আরও বলেন, ৫৪ প্লটের আবেদনগুলো সম্পর্কে দুদক ও এনবিআর যাচাইবাছাই করবে। তাদের ইতিবাচক সাড়া পেলে আবেদন নিষ্পত্তি করা হবে।