মানুষসহ প্রতিটি প্রাণীকেই একদিন মরতে হবে। আমাদের এই পুরো জীবনটা আসলে মৃত্যুর জন্য তৈরি হওয়া। ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র এক লেখায় জীবনকে তারাবাতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারাবাতি যেভাবে অনেক সময় নিয়ে অনেক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। তারপর সেটা কারখানা থেকে বাজারে আসে। বাজার থেকে মানুষ বাসায় নিয়ে আসে। তারপর অপেক্ষায় থাকে কবে উৎসবের দিন আসবে। দিন শেষে যখন সন্ধ্যা নামে তখন তারাবাতির মাথায় আগুন দিয়ে মুহূর্তেই পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়। আমাদের জীবনটাও ঠিক এমনই। কত আয়োজনে আমরা জীবন সাজাই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমি কিনি। বাড়ি করি। গাড়ি হাঁকাই। সন্তানসন্ততিকে বিদেশে সেটেল করি। তারপর একদিন ওই তারাবাতির মতো মরে শেষ হয়ে যাই। শেষ বলতে দুনিয়ার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলছি। নয়তো সত্যিকারের জীবন তো শুরু হয় মৃত্যুর দুয়ারে প্রবেশ করার মাধ্যমে।
হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, মৃত্যুর দুয়ার দুই রকমের হয়। একটি শান্তির মৃত্যু। অন্যটি শাস্তির মৃত্যু। যারা আল্লাহওয়ালা, নবীওয়ালা, অলি-বুজুর্গদের সঙ্গে যাদের দিল জুড়ে থাকে; তাদের মৃত্যু হয় শান্তির। আর যারা আল্লাহর দুশমন, নবীর দুশমন, অলিদের বিরুদ্ধে যারা কাজ করে; তাদের মৃত্যু আসে শাস্তির বার্তা নিয়ে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) এহইয়াউল উলুমুদ্দিনে মৃত্যুর আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, গোনাহগার বান্দার জন্য মৃত্যুর সময় আজরাইলের চেহারা দেখাও বড় ধরনের আজাব। একবার ইবরাহিম নবী আজরাইলকে বললেন, তুমি গোনাহগার বান্দাকে যে সুরতে জান কবজ কর, সে সুরতে তোমাকে দেখতে চাই। আজরাইল বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি তো সে সুরত সহ্য করতে পারবেন না। তারপরও যেহেতু আপনি দেখতে চেয়েছেন দেখুন তাহলে। এই বলে আজরাইল ফেরেশতা মুহূর্তে তাঁর বেশ পাল্টে ফেলেন। ইবরাহিম নবী দেখলেন, আজরাইলের পুরো শরীর ঘোর কালো হয়ে গিয়েছে। তাঁর চুলগুলো শলাকার মতো খাড়া হয়ে গিয়েছে। গায়ের দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। নাকমুখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। এমন ভয়ংকর চেহারা দেখে ইবরাহিম নবী আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অনেক পরে জ্ঞান ফিরলে তিনি বললেন, গোনাহগার বান্দাকে যদি আর কোনো আজাব না-ও দেওয়া হয়, কেবল আজরাইলের এই ভয়ংকর চেহারা দেখার শাস্তিই তার জন্য যথেষ্ট।
অন্যদিকে নেককার বান্দার কাছে আজরাইল ফেরেশতা আসবেন সুন্দর যুবকের বেশে। তাঁকে দেখেই মৃত্যুর আজাব হালকা হয়ে যাবে। সে সুরতও ইবরাহিম নবী দেখেছেন। তিনি আরজ করলেন, ওহে প্রাণহরণকারী আজরাইল গো! তুমি যে সুরতে নেকবান্দাদের জান কবজ কর, তা আমাকে দেখাও। আজরাইল ফেরেশতা সঙ্গে সঙ্গে একুশ বছরের তাগড়া যুবকে পরিণত হলেন। তাঁর চোখে সুরমা। দাড়িতে আতর। পুরো শরীর জরির পোশাকে ঢাকা। যেন কোনো রাজপুত্র দাঁড়িয়ে আছেন। এমন অবস্থা দেখে ইবরাহিম নবী বললেন, মুমিন বান্দাকে যদি আর কোনো পুরস্কার আল্লাহ না দেন, কেবল তোমার এই সুশ্রী চেহারা দেখেই তার মৃত্যু হয়, তবু তার জন্য যথেষ্ট হবে।
নেককার ও গোনাহগার বান্দার মৃত্যুর আলোচনা করতে গিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, যখন কোনো নেক বান্দার মৃত্যুর সময় হাজির হয়, তখন আল্লাহ আজরাইল ফেরেশতাকে ডেকে বলেন, হে আজরাইল! আমার ওমুক বান্দাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সে দুনিয়ায় নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করেছে। এখন সময় এসেছে তার প্রেমাস্পদ প্রভুর সঙ্গে দেখা করার। যাও খুব আদরের সঙ্গে তার জান কবজ কর। নির্দেশ পেয়ে আজরাইল ফেরেশতা তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে ওই নেক বান্দার কাছে ছুটে যান। তাঁর হাতে থাকে রংবেরঙের ফুলের তোড়া। ৫০০ ফেরেশতা দুই সারিতে দাঁড়িয়ে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে থাকেন। এমন দৃশ্য দেখে শয়তানের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। সে দুঃখে কপাল চাপড়াতে থাকে। রাগে মাথার চুল টানতে থাকে। অন্যান্য শয়তান তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি এমন করছ কেন? জবাবে সে বলে, আমি এই ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য কতই না চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে সফল হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা তাকে জান্নাতের খোশখবর শুনিয়ে তার রুহ কবজ করছে। আর যখন গোনাহগারের মৃত্যুর সময় হয় আল্লাহর আজরাইল ফেরেশতাকে ডেকে বলেন, আমার অমুক বান্দা নাফরমানিতে ডুবেছিল জীবনভর। তাকে আমি অনেক সুযোগ দিয়েছি তওবা করার জন্য। অনেকবার মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে ফিরিয়ে এনেছি, হয়তো এতে সে ভয় পাবে। কিন্তু না, সে যতবার সুযোগ পেয়েছে ততবার আগের চেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়েছে। এখন যাও খুব কষ্ট দিয়ে তার জান কবজ কর।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
বিডি প্রতিদিন/এমআই