এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর স্লোগানটি ছিল-‘জন্ম হোক সুরক্ষিত-ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’। ‘জন্ম সুরক্ষিত হোক’ একজন মায়ের জন্য এটি তার মৌলিক অধিকার, এ অধিকার আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারছি! একজন নারীর জীবনে কয়েকটি ধাপ তাকে পার করতে হয়- সবচেয়ে কঠিন ধাপটি হলো মা হওয়ার সময়টি। তিনি মা হতে কখন চাইবেন, হতে পারবেন কি না, সময় হয়েছে কি না, জটিলতা কতখানি-সব জানার অধিকার তার আছে কিন্তু এ প্রাক-সময়টি আমরা কখনই আমাদের স্বাস্থ্য কার্যক্রমের মাঝে প্রাধান্য দিই না, চৎব-ঈড়হপবঢ়ঃরড়হধষ ঈড়ঁহংবষরহম (প্রসব-পূর্ববর্তী) আলোচনার জন্য একটি ধাপ অবশ্যই নারীর জীবনে জরুরি এবং বিশেষ সময়।
প্রসব-পূর্ববর্তী আলোচনার জন্য অবশ্যই প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি স্লোগান হওয়া উচিত-‘২০ বছরের আগে মা হবেন না, ৩৫-এর পর সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকুন’। তার সঙ্গেই মা হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আপনি/আপনারা দুজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এগুলো নিয়ে আমরা অনেকেই কথা বলি না অথবা কম বলি, কিন্তু এ কথাগুলোই পরবর্তী সব জটিলতা থেকে মাকে রক্ষা করতে পারে। প্রসব-পূর্ববর্তী আলোচনার পরই মাকে প্রসবকালীন মা কোথায় যাবেন, কীভাবে দেখাবেন এবং শেষ পর্ব অর্থাৎ প্রসবটি তার কোথায় কবে সেটির গুরুত্ব দিতে হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৫.৪ লাখ নারী (১৫-৪১ বয়সের) প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী, তার মধ্যে ২০১৫-২০১৯ বছরে প্রায় ৫.৩৩ লাখ মা গর্ভধারণ করেন। ২.৬০ লাখ অপরিকল্পিত গর্ভধারণ করেন এবং ১.৫৮ লাখ গর্ভপাত হয়ে যায়।
বয়স অনুযায়ী ২০২৩ এ ১৫-১৯ এর মধ্যে ১ হাজারে ৭৩ জন গর্ভবতী হন। ১৮-এর নিচেই গর্ভধারণ করেন ৪৩%। একজন নারী গর্ভধারণ করবেন এবং সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেবেন, দেওয়ার সুযোগ পাবেন এটি তার মৌলিক অধিকার, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখতে পাই যখনই একজন নারী গর্ভধারণ করেন তখন তিনি তার ইচ্ছে অনুযায়ী একজন চিকিৎসক দেখাতে পারবেন কি না তার জন্য তাকে অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয় সংসার কর্তাদের কাছে। এখানে অনেকটা বিলম্ব হয় তার প্রথম ধাপের চিকিৎসা। এর পরের ধাপেই আসে নিকটস্থ কার কাছে যাবেন, কীভাবে যাবেন, বাহন কী হবে, যেখানে যাবেন সেই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কেউ আছেন কি না এবং সেখানে যথাযথভাবে ডেলিভারি সম্পন্ন করার ব্যবস্থা আছে কি না! এভাবেই আমাদের ‘মা’দের জন্য আমরা অনেক বিলম্ব করি, করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে এখনো সন্তান গর্ভে আসার পর মাত্র একবার ভিজিটে আসেন ৮৩% এবং চারবার আসেন ৪৪% শতাংশ। এর মধ্যে মানসম্মত চিকিৎসা প্রদান করা হয় মাত্র ২১%। এই অবস্থার মধ্যেই আমরা চাই আমাদের প্রতিটি গর্ভবতী মা নিশ্চিন্তে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসবেন এবং আস্থার একটি প্রসবঘর পাবেন, সেখানে তাকে সহায়তা করবেন মিডওয়াইফ, প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক- প্রসবের চিহ্ন নির্ধারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রাখতে হবে-যেমন মিডওয়াইফ ছাড়াও তাকে সঙ্গ দেবেন তার একজন আত্মীয়।
প্রসবঘরটি হবে খোলামেলা, আলো-বাতাস প্রবেশ করে, কিন্তু তার প্রাইভেসি (গোপনীয়তা) ঠিক রাখতে হবে, ডেলিভারির সব সরঞ্জাম থাকবে, রক্তক্ষরণ বন্ধ করার এবং খিঁচুনির চিকিৎসার সব জিনিস হাতের কাছেই থাকবে, মিডওয়াইফ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হতে হবে। মাতৃবান্ধব এই ঘরটি হোক প্রতিটি ‘মা’র জন্য একটি আস্থার জায়গা। তৃণমূল থেকে শহর পর্যন্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে ‘মা’দের জন্য প্রসবঘরটি বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনেক বেসরকারি ক্লিনিক আছে যেখানে আউটডোর থেকে সোজা ‘মা’কে সিজারের জন্য অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয়। প্রসবঘরটি হবে ‘মা’র জন্য প্রাথমিক পরীক্ষার ঘর, এখানে স্বাভাবিক প্রসব ব্যর্থ হলে তিনি অপারেশনে যাবেন। বাংলাদেশে এখনো ৩৫% শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে, মাত্র ১৮ শতাংশ প্রসব হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে, ২% হচ্ছে এনজিওদের প্রতিষ্ঠানে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওজিএসবির সহায়তায় প্রসবঘরের ওপর এবার তৃতীয় অধ্যাদেশ বইটি সরবরাহ করছেন। আমরা ওজিএসবির প্রতিটি সদস্যসহ নার্সিং মিডওয়াইফ সবাই যদি দায়িত্ব নেই তবে প্রসবঘরটি ‘মা’র জন্য একটি আস্থার জায়গা করতে পারবে এবং বাধ্যতামূলক সরকারি আদেশ থাকতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে প্রসবঘরটিকে প্রাধান্য দিয়ে আদেশ জারি করতে হবে।
একজন গর্ভবতী ‘মা’র মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে আসুন আমরা প্রসবঘরটিকে একটি আস্থার জায়গায় পরিণত করি। পরিণত করি মাতৃবান্ধব ও ভরসার স্থান হিসেবে।
-অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ), হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট, ওজিএসবি।