জুলাই জাতীয় সনদ ও বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের ঝড় বইলেও তা আমলে নিচ্ছে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাদের দাবি, দলগুলোর সঙ্গে দিনের পর দিন সংলাপ করে কমিশন তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে সনদ ও তা বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়নি বলে দাবি কমিশনের। তাদের প্রত্যাশা, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই একধরনের মীমাংসার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে। গণভোটের দিকে অগ্রগর হবে। মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐক্য আছে বলে মনে করছে কমিশন।
কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর আজ শেষ হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নির্ধারিত মেয়াদ। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনগুলোর দেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশ হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এতে সংবিধানসংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয় গণভোটের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি প্রদান এবং বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। জাতীয় সনদে সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি, এরপর সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য গণভোট নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে জুলাই সনদে থাকা সুপারিশগুলোর মধ্যে ৯টি সুপারিশ নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যাবে বলে মনে করে কমিশন। অন্যদিকে ২৮টি সংস্কার প্রস্তাব অধ্যাদেশ জারি করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশনের এই সুপারিশের পরপরই বিএনপিসহ কয়েকটি দল এর তীব্র বিরোধিতা করে। পাশাপাশি কমিশনের কঠোর সমালোচনায় অংশ নেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ রাজনীতিতে ঐক্যের বদলে অনৈক্য বা বিভক্তি বৃদ্ধি করবে বলে অভিযোগ উঠেছে। কমিশনের বিরুদ্ধে ‘প্রহসন’ বা ‘প্রতারণা’ করার অভিযোগ এনেছে বিএনপি। তারা জানিয়েছে রেফারিকে তারা কখনো গোল করতে দেখেনি। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই সনদ সই করা হয়েছে, তার সঙ্গে এর বাস্তবায়নের সুপারিশের মিল নেই। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার, ঐকমত্য কমিশন ও দুই-তিনটি রাজনৈতিক দল মিলে একটি পক্ষ তৈরি করেছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে দলটি। আর বিএনপি নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ জামায়াতে ইসলামীর। দলটির নেতারা বলছেন, কমিশনের সুপারিশ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এর বাইরে সনদে স্বাক্ষর করা বাম ঘরানার কয়েকটি দল সমালোচনা করেছে নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের। তাদের বক্তব্য, কমিশন নিজেদের মনমতো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে থেকে ওই দুই বিষয় নিয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।
এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘চাপিয়ে দেওয়া’র নীতি অবলম্বন করেছে বলে মন্তব্য করে তারা। বিষয়টিকে বিপজ্জনক প্রবণতা বলেও তারা জানায়। কারণ এটাকে এখন অ্যালাউ করলে ভবিষ্যতে কোনো পরিস্থিতিতে সংবিধান সংশোধনের জন্য আর নির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রয়োজন হবে না। কোনো একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী আদেশ দিয়েই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে। এ ধরনের উদ্যোগের মধ্যে ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ এবং ফ্যাসিবাদ শাসনের ভিতটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের সমালোচনাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাদের প্রত্যাশা, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বিভাজনের অবসান হবে এবং গণভোটের দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এককভাবে না সকলে মিলে একটা যাত্রার মধ্যে আছি। সেই যাত্রার একটা স্তর সকলে মিলে অতিক্রম করলাম। আমি সৌভাগ্যবান যে আমি এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। মতপার্থক্য থাকলেও ভবিষ্যতের একটা পথরেখা আমরা তৈরি করেছি। গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে মতপার্থক্য থাকবেই। সব মতপার্থক্য নিয়েই আমাদের মিলতে হবে এক জায়গায়। সেটার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। আমি এখনো মনে করি, সবধরনের মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐক্য আছে। আমরা হয়তো ধীরগতিতে আগাচ্ছি তবে আমি মনে করি আমরা সফল হব।’ দলগুলোর সমালোচনাকে কীভাবে দেখছেন প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশন তার প্রস্তাব দিয়েছে। যে কোনো কমিশনের ক্ষেত্রে যেটা হয় আমাদের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। আমরা আমাদের সুপারিশ দিয়েছি সরকারকে। এখন তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে বাস্তবায়ন করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু ভিন্নমত আছে, থাকবে। আমরা আশা করি, এই ভিন্নমতগুলো আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই একধরনের মীমাংসার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। গণভোটের দিকে অগ্রসর হতে হবে।’
একই প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিশন অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সবচেয়ে ভালো চেষ্টাই করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করে ঐতিহাসিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়েছে কমিশন। সব ধরনের অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে শতভাগ চেষ্টা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।