পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। এ অবস্থায় এসব সুবিধার ওপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখার প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। গতকাল ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন’ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন। সেমিনার আয়োজন করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রকল্প (এসএসজিপি)। এদিকে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক কর্মশালায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ তিন বছর পেছাতে চায় সরকার।
ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যতে এলডিসি হিসেবে পাওয়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা কমে আসবে। তাই এ সুবিধাগুলো না থাকলেও যাতে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারে, তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া অপরিহার্য। বেসরকারি খাতে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এতে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। একই সঙ্গে, তিনি সুলভ ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেন।
ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, বিভিন্ন দেশ, উন্নয়ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাঠামোগত রূপান্তরে আর্থিক, কারিগরি এবং বাণিজ্য-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ সমন্বিত কার্যক্রমের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সম্প্রতি প্রণীত ‘স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি’-তে দেওয়া হয়েছে, যার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
সেমিনারে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি জনগণের ক্ষমতায়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপর জোর দেন অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. জুলফান তাজুদিন। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মাহমুদুল হাসান খানসহ বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সময়সীমা আরও তিন বছর বাড়ানোর আহ্বান জানান।
এ সময় বক্তব্য দেন প্রাক্তন সচিব আবদুল বাকি, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. কাজী ইকবাল।
এলডিসি থেকে উত্তরণ তিন বছর পেছাতে চায় সরকার-বাণিজ্য সচিব : সরকার এলডিসি (স্বল্পন্নোত দেশ) থেকে উত্তরণ (গ্রাজুয়েশন) তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এনিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম, কারণ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অনেক রাষ্ট্রই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক কর্মশালায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এসব কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ও এলডিসি গ্রাজুয়েশন বিষয়ক এ কর্মশালার আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)। র?্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. আবু ইউসুফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি দৌলত আক্তার মালা। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য সচিব বলেন, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছি, চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখব না। মূলত বাণিজ্য সুবিধা আরও কিছুদিন বজায় রাখারই প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি রেজল্যুশন পাস করাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপান, তুরস্ক, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রই এর বিরোধিতা করছে। এ অবস্থায় রেজল্যুশন পাস করানো কঠিন। তাই তাদের কাছ থেকে আমরা কারিগরি সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছি। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে আগামী এক বছরে দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমতে পারে। একইভাবে দেশটিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর রপ্তানিও কমবে। চীনের ৫৮ শতাংশ, ভারতের ৪৮ শতাংশ, ভিয়েতনামের ২৮ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ২৭ শতাংশ পর্যন্ত রপ্তানি হ্রাস পেতে পারে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশ উচ্চ ট্যারিফের মধ্যেও মার্কিন বাজার ধরে রেখেছে, যা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দেখায়। যুক্তরাষ্ট্র কৃষি ও শিল্পপণ্যের বাজারে বেশি আগ্রহী। দেশের প্যাকেজিং, মাছ ও কৃষিপণ্য রপ্তানি সীমাবদ্ধ, তাই বাণিজ্য চুক্তি বাস্তব সক্ষমতার ওপর নির্ভর। জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের বাজার সুরক্ষিত, তবে বিনিয়োগের ঘাটতি ও ব্যাংকিং দুর্বলতা গ্রাজুয়েশনের পর চাপ তৈরি করতে পারে। নেগোশিয়েশন দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।
ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বিশ্ববাজারে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের তৈরি পোশাক আমদানি প্রায় ১২ শতাংশ বা ১০ বিলিয়ন ডলার কমতে পারে। বাংলাদেশ তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রপ্তানি প্রায় ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। ভারত ও চীনের ক্ষতি আরও বেশি হতে পারে, ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের চাপ সৃষ্টি হবে এবং দাম কমতে পারে। বাংলাদেশের বাজার শেয়ার কিছুটা বাড়লেও মোট রপ্তানি নাও বাড়তে পারে। শুল্ক ও প্রতিযোগিতা দুই-ই রপ্তানিকারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
দৌলত আক্তার মালা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের আগে সঠিক তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। সরকার দ্বিধায় আছে, সময়মতো ‘বোমা’ নিস্ক্রিয় করবে নাকি রেখে দেবে। পারস্পরিক শুল্কনীতি ও উত্তরণের পর কর কাঠামোয় চাকরি হারানো ও স্থানীয় শিল্প ক্ষতির আশঙ্কা আছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে, বাণিজ্য চুক্তিতে যোগদানে অগ্রগতি নেই। বাণিজ্য আলোচনার দল গঠন ও উত্তরণের মানদণ্ড পুনর্বিবেচনা জরুরি, যাতে শক্ত যুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনায় অংশ নেওয়া যায়।