ভোট গ্রহণের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ফল প্রকাশ করতে পারেনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন কমিশন। সময় যত গড়াচ্ছে জাকসুর ফল নিয়ে ততই বাড়ছে নাটকীয়তা। ফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এরই মধ্যে নির্বাচন কার্যক্রমে পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা (৩১) ভোট গণনা চলাকালে গতকাল মারা গেছেন। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার। নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেছেন নির্বাচনে ছাত্রশিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ওএমআর-এর বদলে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে (হাতে ভোট গণনা) কার্যক্রম চলায় দেরি হচ্ছে ফল প্রস্তুত করতে। গতকাল সন্ধ্যায় ২১টি হল সংসদের ভোট গণনা শেষে শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনার কাজ। তবে গত রাতেই অনানুষ্ঠানিকভাবে হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার কথা।
ভোট গণনা ও ফলাফলে কেন এত দেরি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম গতকাল জানান, ওএমআর মেশিন দিয়ে ভোট গণনার জন্য প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বেশ কয়েকজন প্রার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যানুয়ালি (হাতে ভোট গণনা) করার সিদ্ধান্ত হয়। ম্যানুয়ালি হিসাব করলে একটু বেশি সময় লাগবে, এটা তো স্বাভাবিক।
গতকাল সন্ধ্যায় জাবি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ভোট গণনা কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘অমানবিক পরিশ্রম করে আমাদের এ কাজটি করতে হচ্ছে। একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেশিনে গণনার প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন স্থগিত করেছে। আমি অবগত হয়েছি।’
গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা শুরু হয়। জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে বিকাল ৫টার দিকে ২১টি হল সংসদের ভোট গণনা শেষ হয়। এরপর ভোট গণনা বন্ধ করে জরুরি সভায় বসেন শিক্ষকরা। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, জনবল বাড়িয়ে ভোট গ্রহণ শেষে আজকের (গতকাল) মধ্যেই ফল ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে ম্যানুয়ালি পদ্ধতিতেই (হাতে ভোট গণনা) চলবে গণনার বাকি কার্যক্রম।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফলাফল ঘোষণার দাবিতে স্লোগান দেন। তাদের অভিযোগ, ভোট গ্রহণের একদিন পরও ফলাফল প্রকাশ না করা অগ্রহণযোগ্য।
জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। প্রায় ৬৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদে মোট ২৫টি পদে লড়েছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। ভিপি পদে ৯ ও জিএস পদে ৮ জন প্রার্থী ছিলেন। ছাত্রীদের ১০টি আবাসিক হলে ১৫০টি পদের মধ্যে ৫৯টিতে কোনো প্রার্থী ছিলেন না। একজন করে প্রার্থী ছিলেন ৬৭টি পদে। সে হিসাবে মাত্র ২৪টি পদে ভোট নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি হলের মধ্যে দুটি হলে (সুফিয়া কামাল ও নওয়াব ফয়জুন্নেসা) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচনের দিন ভোট বর্জন করেছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলসহ আরও চারটি প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। বিচ্ছিন্ন অব্যবস্থাপনার মধ্যেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এমন দাবি করে এখনো পর্যন্ত চলমান ভোট কার্যক্রমের ফলাফল চায় বাকি তিনটি প্যানেল। প্যানেল তিনটি হলো- ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেল।
নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র, দাবি জিএস প্রার্থী মাজহারুলের : জাকসু নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন নির্বাচনে ছাত্রশিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। নির্বাচন বানচালে বিএনপিপন্থি দুই শিক্ষক ইন্ধন দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। গতকাল বিকালে জাকসু নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে মাজহারুল ইসলাম এ অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। ভোট গ্রহণের একদিন পার হলেও ভোট গণনা শেষ হয়নি। একদিন পরও শুধু হল সংসদের ভোট গণনা শেষ হয়েছে। জাকসু নির্বাচনের ভোট গণনা এখনো শুরুই হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এখানে সুস্পষ্টভাবে আমরা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাচ্ছি। আমরা ভোটের আগের দিন থেকে প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে বলে আসছিলাম যে কোন জায়গাগুলোতে লুপ হোল রয়েছে, কোন জায়গাগুলোতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেন। আমরা একটি ফেয়ার নির্বাচন চাই, শিক্ষার্থীরা যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দেবেন, কিন্তু আপনারা ফেয়ার নির্বাচন করেন।’
নির্বাচন বানচালে বিএনপিপন্থি দুই শিক্ষক ইন্ধন দিচ্ছেন অভিযোগ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন বানচালের ইন্ধন দিচ্ছেন বিএনপিপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার (নির্বাচন কমিশনের সদস্য)। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম একটি হলের প্রাধ্যক্ষ হয়েও অন্য একটি ছাত্রী হলে ঢুকে মব সৃষ্টি করেন, যার ফলে নির্বাচন কিছুক্ষণ স্থগিত হয়। ছাত্রদলকে ব্যবহার করে তিনি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। হলের বাইরে অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে দেখা গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আজকে সকালে একজন শিক্ষিকা নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করতে এসে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, যিনি গতকাল দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু নজরুল ইসলামের গ্রুপ সেটাকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার চেষ্টা করছে।’
জামায়াতপন্থি প্রতিষ্ঠান থেকে ওএমআর নেওয়ার দাবি মিথ্যা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ওএমআর যে প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হয়েছে সেটিকে জামায়াত ট্যাগ দিয়ে বাতিলের চেষ্টা করেছে ছাত্রদল ও বাগছাস। জামায়াতপন্থি যদি কোনো কিছু থাকে, আপনারা দেখতে চাইবেন সে যন্ত্রটি ঠিক আছে কি না; সেটা আপনাদের কনসার্ন থাকা উচিত ছিল, কিন্তু আপনারা কনসার্ন জানিয়েছেন সেটি জামায়াতপন্থি কি না। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, সেটি জামায়াতপন্থি নয় বরং বিএনপিপন্থি ছিলেন।’
ওএমআরে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত বাতিলের প্রসঙ্গ টেনে শিবিরের ওই নেতা বলেন, ‘তার গ্লানি এখনো আমাদের টানতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যারা ভোট গণনা করছেন তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বাস্তবিকভাবে কোনোভাবেই আজকের মধ্যে ভোট গণনা করা সম্ভব নয়। ওএমআরের মতো ঠুনকো অজুহাতে ছাত্রদল নির্বাচন বানচাল করতে চায়।’
অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষকের মৃত্যু : চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতার মৃত্যুর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ সময় ধরে চলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দায়িত্বরত সবাই ভীষণ অসুস্থ এবং ক্লান্তিবোধ করছেন। এ ছাড়া কখন শেষ হবে ভোট গণনার কাজ এবং প্রকাশ করা হবে ফলাফল, তারও কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল কেন্দ্রের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা আক্তার এ মৃত্যুর ঘটনার সঠিক বিচারের পাশাপাশি জান্নাতুল ফেরদৌসের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো কলাভবনের সামনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালনের কারণে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যেভাবে ভোট গণনা হচ্ছে, তাতে তিন দিনেও শেষ হবে না বলে মনে করছেন এই শিক্ষক।
ভোট গণনা পদ্ধতির পরিবর্তন দাবি করে এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘হল সংসদে একটি মাত্র ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট হচ্ছে; কিন্তু জাকসুতে তিনটা করে। অর্থাৎ যদি ৮ হাজার ভোট কাস্ট হয়ে থাকে তবে ২৪ হাজার গুনতে হবে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব, তিন দিনেও তো এটা সম্ভব হবে না।’
নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ : পদত্যাগ করেছেন জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের এ অধ্যাপক বর্তমানে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি। গত রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের সামনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সিদ্ধান্ত জানান।
তিনি বলেন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক আগে থেকেই বহু প্রশ্ন উঠেছে। নানান অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে পরামর্শ দিলেও নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেয়নি। জাকসু নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে আজ (গতকাল) বিকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে আমি ভোট গণনা স্থগিত রেখে যেসব বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তার সমাধান চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি এটি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতা আমাকে পীড়া দিচ্ছে। তাই দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলাম।
এর আগে নির্বাচনের দিন বৃহস্পতিবার আরও তিন বিএনপিপন্থি শিক্ষক নির্বাচনে অব্যবস্থাপনা ও কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।
ভোট গণনা চলাকালে শিক্ষিকার মৃত্যু : জাকসুর ভোট গণনাকালে অসুস্থ হয়ে এক নারী পোলিং অফিসার মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রভাষক।
গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় জাকসুর নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করতে এসে দরজার সামনে অচেতন হয়ে পড়ে যান তিনি। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে সাভারের এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা প্রত্যক্ষদর্শী আল মাহাদি বলেন, সাড়ে ৮টার দিকে ম্যাম ভোট গণনার জন্য নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আসেন। এ সময় তিনি দরজা খুলতে গেলে সেখানে অচেতন হয়ে পড়েন। পরে নারী শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখান থেকে তার স্বামীর উপস্থিতিতে তাকে এনাম মেডিকেলে পাঠানো হয়।
তবে তিনি গতকাল রাতে নির্বাচনি কাজে দায়িত্বরত ছিলেন না। আজ সকালেই তিনি দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন। কমিশন কক্ষে প্রবেশের আগেই অচেতন হয়ে পড়ে যান তিনি।
উল্লেখ্য, জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ এবং ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা (চিত্রকলা : শৃঙ্খলা) বিভাগ থেকে এমএফএ এবং বিএফএ সম্পন্ন করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে (শৃঙ্খলা : চিত্রকলা) প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।