সংস্কার, বিচার ও সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল মহাসমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সমাবেশ থেকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থাসহ ১৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। বক্তব্যে দলের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনের বিকল্প নেই। নইলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। তিনি বলেন, ইসলামপন্থিদের ঐক্যের ব্যাপারে গণ-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। জোটবদ্ধ ইসলামি দলগুলো হবে আগামী দিনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। আগামী নির্বাচনে কোনো দল নয়, ক্ষমতায় যাবে ইসলাম। গতকাল বেলা ২টায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও ভোর থেকেই সারা দেশ থেকে আসা নেতা-কর্মীরা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হন। সমাবেশে লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর সমাগম হয়েছে বলে দাবি করেছেন আয়োজকরা। সমাবেশে জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন। পীর চরমোনাই বলেন, পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। জনগণের ভোটের অবমূল্যায়ন রুখতে সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু করতে হবে। সংস্কারের প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলন অটল ও অবিচল জানিয়ে বলেন, সংস্কারে কালক্ষেপণ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে বেইমানির শামিল। মানুষ দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন দেখার জন্য জীবন দেয়নি। ভবিষ্যতে দেশের জনগণ কোনো চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজকে সংসদে পাঠাবে না।
মহাসমাবেশে তিন দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজী, নেজামে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানি, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি বশির উল্লাহ, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিও প্রমুখ। মহাসমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। ঘোষণাপত্রে সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দেওয়াসহ ১৬ দফা দাবি জানায় দলটি। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে- সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির পুনঃস্থাপন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী মাসের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা। মৌলিক রাষ্ট্রসংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি, পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিতকরণ এবং বিদেশে পলাতক অপরাধীদের আটক করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদারকরণ। দেশ থেকে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সক্রিয়, কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি রোধে প্রশাসনকে আরও কার্যকর করা। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ এবং সব দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করা। জাতীয় নির্বাচনের আগে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা এবং আগামীতেও জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও সন্ত্রাসীদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। ঘুষ, দুর্নীতিসহ সব ধরনের নাগরিক হয়রানি বন্ধ করা। দেশবিরোধী ও ইসলামবিরোধী সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্র্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক ও ইসলামি শক্তির ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তোলা। এ ছাড়া রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে ইসলামের সুমহান আলোকিত আদর্শের অনুশীলন। সকাল ১১টা থেকে আঞ্চলিক নেতারা মঞ্চে বক্তৃতা রাখেন। এরপর দুপুর ২টা থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি। মহাসমাবেশ ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল লোকারণ্য। উদ্যানের পার্শ্ববর্তী মূল সড়ক শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, মৎস্য ভবন এলাকাও ছিল দলের নেতা-কর্মীদের পদচারণে মুখর। এদিকে কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার পথে যশোরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছয় নেতা-কর্মীর জন্য মহাসমাবেশে শোক প্রকাশ করা হয়।
দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, বিএনপি দাবি করেছে তারা জাতীয় সরকার গঠন করবে। একটি সর্বদলীয় সংসদ গঠন করতে পিআর হচ্ছে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। বিএনপিরও তা মেনে নেওয়া উচিত। বিএনপি বলেছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে এই গ্যারান্টি কে দিয়েছে? তিনি আরও বলেন, আজকে বিভিন্ন দলের যারা এখানে এসেছেন, তারা মোনাফেকি না করলে আগামীতে ইসলামি শক্তি ক্ষমতায় আসবে। আমরা নিজেরা ক্ষমতায় যেতে চাই না। কোরআন ও সুন্নাহকে ক্ষমতায় নিতে চাই। মহাসমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, অধ্যক্ষ আশরাফ আলী আকন্দ, যুগ্ম মহাসচিব প্রকৌশলী মোহাম্মদ আশরাফুল আলম, নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হক আজাদ, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ, কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব কে এম আতিকুর রহমান, মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম, দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল আউয়াল প্রমুখ।