পরমাণু স্থাপনায় হামলার জেরে কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। গত রাতে ইরাকে একটি ঘাঁটি ও কাতারে আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে এ হামলা চালায় তেহরান। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসনিম রাতে এ খবর দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাও ইরানের এ হামলার কথা নিশ্চিত করেছেন। স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে যোগ করেন ওই কর্মকর্তা। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে এ অপারেশনের নাম দিয়েছে ‘ও আবু আবদুল্লাহ’ যার ইংরেজি অর্থ ‘ব্লেসিংস অব ভিক্টরি’। এদিকে কাতার দেশটির মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে হামলাকে কাতারের সার্বভৌমত্ব ও আকাশসীমার স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে।
তিনটি পরমাণু স্থাপনায় ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার জবাবে পাল্টা হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইরান। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান আবদোল রহিম মোসাভি বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘অপরাধী যুক্তরাষ্ট্রের জানা উচিত যে ইসরায়েল নামের অবৈধ ও আগ্রাসি সন্তানের শাস্তির পাশাপাশি ইসলামের যোদ্ধাদের হাত এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মুক্ত। এ বিষয়ে আমরা কখনোই পিছপা হব না।’ এ হুঁশিয়ারির পরপরই তেহরানের তরফে ইরাক ও কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার ঘটনা ঘটল।
উল্লেখ্য, এর আগে সিরিয়ায় একটি মার্কিন ঘাঁটিতে মর্টার হামলা হয়েছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাসাকাহ প্রদেশের কাসরুক এলাকায় এ হামলা ঘটে। গতকাল ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়। এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যে কাতার এয়ারওয়েজ সব ধরনের ফ্লাইট স্থগিত করেছে। এয়ারলাইনসটি গতকাল এক্স-হ্যান্ডলে বিবৃতিতে এ তথ্য জানায়। কাতার ও বাহরাইন তাদের আকাশসীমা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার মধ্যেই এয়ারলাইনসটির ফ্লাইট স্থগিতের ঘোষণা আসে। কাতার গতকাল সন্ধ্যায় তাদের আকাশপথ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। দেশটির সিভিল অ্যাভিয়েশনের সার্কুলারে আকাশপথ বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন একটি সূত্রের বরাতে জানায়, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার আগে দোহাকে আগাম জানিয়েছিল ইরান। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যাতে ন্যূনতম থাকে তা নিশ্চিত করতেই আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সূত্র।
মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরানের সামরিক বাহিনী। তবে তেহরানের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র যে কটি বোমা ব্যবহার করে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ঠিক সমপরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে তারা।
কাতারের রাজধানী দোহা থেকে অদূরে আল উদেইদ এলাকায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিটি অবস্থিত। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সর্বশেষ খবর পর্যন্ত কোনো তথ্য আসেনি বলে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে স্যাটেলাইট চিত্র অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় এ ঘাঁটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিমান সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ড ইউএস সেন্টিনোমের সদর দপ্তর অবস্থিত আল উবেইদ ঘাঁটিতে। ব্রিটেনের সামরিক বাহিনীও তাদের যুদ্ধবিমান ও সরঞ্জাম রাখার জন্য এ ঘাঁটিটি ব্যবহার করে।
ইরান এবং ইসরায়েল গতকালও একে অপরকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। গতকাল ইরানের মেহের নিউজ এক প্রতিবেদনে জানায়, সিরিয়ার কাসরুক অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে হঠাৎ করে মর্টার হামলা চালানো হয়। তবে এ হামলা কে করেছে, হামলার ধরন বা এতে কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে-সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ঘটনার পরপরই মার্কিন সেনারা পুরো ঘাঁটির চারপাশ ঘিরে ফেলে এবং ওই এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে, ইরানে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ। তিনি বলেন, ‘নজিরবিহীন শক্তি’ দিয়ে ইরানে হামলা চালানো হচ্ছে। তেহরানে যেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা হয়েছে সেগুলোকে ‘শাসক গোষ্ঠীর প্রতীক’ বলে উল্লেখ করেছেন কাটজ। পূর্ণ শক্তিতে হামলা চলতে থাকবে, বলেছেন তিনি। কোন কোন লক্ষ্যে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছেন কাটজ। এর মধ্যে আছে, বাসিজ মিলিশিয়ার সদর দপ্তর। ইরান সরকার বিক্ষোভ দমনে প্রায়ই এই মিলিশিয়াকে কাজে লাগিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আছে ইরানের এভিন কারাগার। সেখানে রাজবন্দি এবং ইরানের শাসক গোষ্ঠীর শত্রুদের আটক রাখা হয়। এই কারাগারেও আঘাত হেনেছে ইসরায়েল। কারাগারের প্রবেশপথে বিস্ফোরণের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এ কথা নিশ্চিত করেছে বিবিসি ভেরিফাই। এ ছাড়াও নগরীর একটি ঘড়িতে আঘাত হেনেছে, যে ঘড়ি প্রতিনিয়ত ইসরায়েলের ধ্বংসের সম্ভাব্য দিনের সময় গণনা করে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দপ্তরসহ সরকারসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভবনেও ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে।
যুদ্ধ শেষ করতে চায় ইসরায়েল : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার আরব মিত্রদের মাধ্যমে ইরানের কাছে ইসরায়েলের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। আরব ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গতকাল মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেওয়া ছাড়া ইরান এখনই অভিযান শেষ করতে চায় না।
ইরানের ৬ বিমানবন্দরে হামলা : ইরানের পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের অন্তত ছয়টি বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। পাশাপাশি এসব হামলায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আকাশযান ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, পশ্চিম, পূর্ব ও মধ্য ইরানের বিমানবন্দরগুলোতে রাতভর এই হামলা চালানো হয়েছে। পাশাপাশি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সামাজিক মাধ্যম ‘এক্সে’ এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ১৫টি বিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল মেহরাবাদ, মাশহাদ ও দেজফুল বিমানবন্দর।
তেহরানে বিপ্লবী গার্ডের সদর দপ্তরে হামলা : ইরানের রাজধানী তেহরানে দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সদর দপ্তরে হামলা চালানোর দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। হামলায় আইআরজিসির সৈন্য হতাহত হয়েছেন বলেও দাবি করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন। তিনি বলেছেন, তেহরানে চলমান ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদর দপ্তরেও আঘাত হানা হয়েছে।
ইসরায়েল ইরানে তার লক্ষ্য পূরণের খুব কাছাকাছি, বললেন নেতানিয়াহু : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল ইরানের ওপর পরিচালিত অভিযানে তাদের মূল লক্ষ্য অর্জনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বিশেষত দেশটির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ব্যাপক ক্ষতিসাধনের ক্ষেত্রে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েল দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়াতে চায় না, তবে লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধও করবে না।