অনেক প্রত্যাশা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের কাঠামোতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। থাকছে না নতুন কোনো চমক। বরাদ্দের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন হলেও মূল জায়গায় কোনো পরিবর্তন না দেখে উদ্বিগ্ন বিশ্লেষকরা। সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়ায় বাজেট সংকট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন স্বয়ং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
২০২৪ সালের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট এটি। স্বাভাবিকভাবেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের
বাজেট ঘিরে সবার প্রত্যাশাটা অনেক বেশি। বাজেটে শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিটির সুপারিশ খুব বেশি আমলে নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, কর খেলাপি এবং পাচার হওয়া অর্থ জব্দ করতে পারলে এ বছরের বাজেট আরও অন্তর্ভুক্ত হতো। তবে দুর্ভাগ্যবশত এবারের বাজেট গতানুগতিকভাবে পরিকল্পিত এবং নতুন চমক থাকছে না। তিনি বলেন, গত সরকারের আমলে ঋণের চাপ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তবে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপে ঋণ পরিশোধে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। বাজেটে তেমন কোনো নতুন উদ্যোগের আশা না থাকায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো সেগুলো অব্যাহত আছে। রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সরকারের কাছে বাজেট নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল দলীয় সরকারগুলো যে বাজেট দেয়, তা থেকে বেরিয়ে একটা জনমুখী, বৈষম্যবিরোধী, উন্নয়নমুখী বাজেট। কিন্তু বাস্তবতাটা ভিন্ন। অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের বাজেট কাঠামোর পথেই হাঁটছে। বাজেটে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা দেখছি না। বরাদ্দের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন হবে। কিন্তু মূল জায়গায় আমরা কোনো পরিবর্তন দেখছি না। বরং উদ্বেগের কিছু কিছু জায়গা আছে। প্রশ্ন উঠছে, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এবারের বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত যেটা জানা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এসব খাতে খুব পরিবর্তন হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা আছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করেন। স্বভাবতই বিনিয়োগে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।
গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিবেশ অধিদপ্তর মিলনায়তনে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাজেট সংকট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা সরকারের অন্যতম সর্বনিম্ন বাজেট পাওয়া মন্ত্রণালয়। ইটভাটা বন্ধ, হাতি-মানব দ্বন্দ্ব মোকাবিলা, সিসিটিভি স্থাপনসহ নানা কার্যক্রমে বাজেট ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি শূন্য পদ পূরণ ও জমিসংক্রান্ত আইন সংস্কারের ওপর জোর দেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহার ও কর বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তাদের জীবনযাত্রাকেও ব্যয়বহুল করে তুলবে। কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি শিল্প ও ভোক্তা সুরক্ষার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।