ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ সপ্তাহ পেরিয়ে গতকাল অষ্টম দিনে গড়িয়েছে। এদিনও উভয় পক্ষ একে-অপরের ওপর দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদেশি নাগরিক ও কূটনীতিকদের রাজধানী তেল আবিব ও তেহরান ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। এদিকে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ইরানকে বারবার সমঝোতার প্রস্তাব পাঠানোর পাশাপাশি ওই অঞ্চলে বিপুল সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছে। সূত্র : আলজাজিরা, আনাদোলু এজেন্সি, টাইমস অব ইসরায়েল, রয়টার্স ও বিবিসি।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, এক সপ্তাহ ধরে চলমান হামলা-পাল্টা হামলার মাঝে ইরানের রাজধানী তেহরানের আরেকটি হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান এক বিবৃতিতে বলেন, এ নিয়ে তৃতীয় হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রও নির্মমভাবে ইহুদিবাদী শত্রুদের হামলার শিকার হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তেহরান এবং অন্যান্য শহরে ১২৫ মিনিটব্যাপী বিমান অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী (আইএএফ)। আইএএফের ৫০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান এ অভিযানে অংশ নিয়েছে। অভিযানে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস এবং সামরিক বাহিনীর এক কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কোথাকার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং ইরানি সামরিক বাহিনীর কোন কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে তা আইডিএফ জানায়নি।
ইসরায়েলের অভিযান নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি তেহরান। তবে পাল্টা আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তেহরান বলেছে, গতকাল ভোর থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সংবাদ সূত্রগুলোর তথ্যানুযায়ী, ভোর থেকেই দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি হামলা চালাতে থাকে। তেহরানের ভাষ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত তারা কোনোরকম অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তবে প্রয়োজনে এগুলো ব্যবহারে দ্বিধা করা হবে না। গতকালের আক্রমণেও তারা সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এতে ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুপুরের দিকে পাওয়া এক খবরে জানা গেছে, ইরান এবার ১৭তম বারের মতো ৩৯টি নতুন মিসাইল ছুড়েছে ইসরায়েলে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র সারা দেশের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, প্রায় ৩৯টি ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ। এক্স পোস্টে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে, ইরান থেকে একগুচ্ছ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। আকাশ প্রতিরক্ষা এসব হামলা ঠেকাতে সক্রিয় হয়েছে। ইরানের তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস এবং সামরিক বাহিনীর এক কমান্ডারকে হত্যার দাবি করার পর ইসরায়েলে এ হামলা চালানো হয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ গতকাল সামরিক বাহিনী আইডিএফের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জমির ও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ইরানের রাজধানী তেহরানের ওপর আরও তীব্র বিমান হামলা চালিয়ে দেশটির সরকার ব্যবস্থাকে ‘অস্থিতিশীল’ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কাৎজ বলেন, ‘আমরা তেহরানে শাসকগোষ্ঠীর সব প্রতীক ও দমনমূলক ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু বানাব। বসিজ বাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) থাকবে টার্গেটে।
বিদেশিদের রাজধানী ত্যাগের হিড়িক : পাল্টাপাল্টি হামলার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল ও ইরান থেকে নিজ নিজ নাগরিকদের সরিয়ে নিতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ১৩ জুন সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল থেকে ১ হাজার ২০০ জন নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আপাতত তাদের সবাইকে সাইপ্রাসে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া চীন ইরান থেকে ১ হাজার ৬০০ জন এবং ইসরায়েল থেকে বেশ কয়েক শ নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছে। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আপাতত এই নাগরিকদের আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক, আর্মেনিয়া এবং ইরাকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ইরান ও ইসরায়েলে অবস্থানরত নাগরিকদের ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দিয়েছে নয়াদিল্লি। যারা যোগাযোগ করেছেন, তাদের আপাতত আর্মেনিয়ায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তারপর সেখান থেকে ভারতগামী ফ্লাইট ধরবেন তারা।
একই সঙ্গে নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে দুটি সামরিক বিমান পাঠাচ্ছে জাপান। বিমান দুটি আপাতত আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে অবস্থান করবে। তারপর সেখান থেকে ইরান এবং ইসরায়েলে গিয়ে জাপানি নাগরিকদের তুলে নেবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার এবং ইরানে ২৮০ জন জাপানি অবস্থান করছেন।
সমঝোতার জন্য ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের বারবার অনুরোধ : মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলার প্রেক্ষাপটে ইরানকে বারবার সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এসব প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে তেহরান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি গতকাল এ বিষয়ে জানান, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে একাধিক ‘গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক বার্তা’ ইরানের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি ‘ইসরায়েলের আগ্রাসনের অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের বলার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে কোনো আলোচনার প্রশ্নই আসে না। এটি আমাদের আত্মরক্ষার অধিকার। কোনো সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন দেশই নিজের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে আলোচনায় বসে না।’ আরাগচি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন, ‘ইসরায়েলি হামলা যতদিন চলবে, ততদিন ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আলোচনা করবে না।’ তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে জেনেভায় গতকালই যে কূটনৈতিক বৈঠক হওয়ার কথা, সে সম্পর্কেও কথা বলেন তিনি। আরাগচি বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের জানান, এ বৈঠকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কালাসের থাকার কথা রয়েছে। তিনি এও বলেন, ‘অপরাধের অংশীদার হওয়ায় আমেরিকার সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা নেই।’
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর প্রথমবারের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য জেনেভায় গেছেন আরাগচি। সেখানেই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সামাজিক মাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘শত্রুর আগ্রাসন নিঃশর্তভাবে বন্ধ এবং ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অভিযান চিরতরে অবসানই আরোপিত এই যুদ্ধ বন্ধের একমাত্র পথ। অন্যথায় শত্রুদের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া আরও বেশি গুরুতর এবং ভয়াবহ হবে।’
কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা : সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, গতকাল জেনেভায় ইরানি প্রতিপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক শুরু হওয়ার খবর আসেনি। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ বৈঠকের ওপর ভিত্তি করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। জানা গেছে, বৈঠকে ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানি পক্ষকে মার্কিন পরিকল্পনার বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করবেন। তারা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফের কাছ থেকে পাওয়া ‘স্পষ্ট বার্তা’ পৌঁছে দেবেন।
সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ইসরায়েলে একের পর এক বিমান : সামরিক সূত্রগুলোর তথ্যানুযায়ী, ইরানের হামলায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটি ইরানের হামলা ঠেকাতে ক্রমশ ব্যর্থ হয়ে পড়ছে। ইসরায়েলের আয়রন ডোম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ফাঁকি দিয়ে একের পর এক মূল ভূখণ্ডে আছড়ে পড়ছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি থেকে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ইসরায়েলে নামছে এক ডজনের বেশি বিমান। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি থেকে ১৪টি সামরিক কার্গো বিমান ইসরায়েলে এসে পৌঁছেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এসব বিমান সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ বহন করছে, যা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশনাল প্রস্তুতি’ জোরদারে সহায়তা করবে। চালানটি ১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর গঠিত আকাশ ও সমুদ্রপথে সহায়তা চ্যানেলের অংশ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৮০০টিরও বেশি সামরিক কার্গো বিমান ইসরায়েলে এসেছে। তবে এসব বিমানে কী ধরনের সরঞ্জাম এসেছে, সে বিষয়ে তিনি তথ্য প্রকাশ করেননি।
হতাশ নেতানিয়াহু : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় নিতে চাওয়ায় গভীরভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার জোট। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজের কলামিস্ট গিডিয়ন লেভি বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় দুই সপ্তাহ মানে ‘চিরকাল’। ট্রাম্প যদি সত্যিই অপেক্ষা করেন ও এটা যদি ‘কৌশলগত বিভ্রান্তি’ না হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা প্রতিনিয়তই কমছে।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিকভাবে নেতানিয়াহুর টিকে থাকার অন্যতম কৌশল হলো- যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনা। কিন্তু ট্রাম্পের সময় নিতে চাওয়ার সিদ্ধান্তকে নেতানিয়াহুর আকাঙ্ক্ষায় বড় ধাক্কা হিসেবে মনে করা হচ্ছে।